মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার প্রচারক মওলানা শাহ্ সূফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.)

0 702

১৮৬৫ সালে ১৪ অক্টোবরের সোমবার গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ আবদুল করিম মাইজভাণ্ডারীর ঘরে ভোর বেলায় ‘বেলায়তে মোতলাকা’ যুগের রাজধানী মাইজভাণ্ডার শরিফে জন্মগ্রহণ করেন রূপ-লাবণ্যে দৃষ্টান্তরূপ এক সন্তান। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীসহ বেলায়ত নগরীর প্রত্যেকে নবজাতকের চেহারা মোবারক দেখে আনন্দে মুখরিত হয়ে যাচ্ছেন। যেন নবজাতকের চেহারা মোবারকই বলে দিচ্ছে সে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর বেলায়তের মহান বাগানের (ত্বরিকার) ফুল ও তাঁর এক মহান প্রতিনিধি। স্মর্তব্য, তৎসময়ের বহু আগে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) অলৌকিক ত্রাণ কর্তৃত্বের যশ-খ্যাতি বাংলা, বার্মা, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান তথা সমগ্র উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তদুপরি এত বড় অলিউল্লাহ্ নবজাতকের বড় জেঠা এই পবিত্র নগরীতে অবস্থান করছেন- মঙ্গলের জন্য তাড়াতাড়ি বড় ভাইয়ের কাছে নিজ সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানকে নিয়ে গেলেন পিতা। ঠিক তখনই পবিত্র জবানে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) অমৃতময় বাণী- “ইয়ে হামারে বাগ কা গোলে গোলাব হ্যায়, হযরত ইউসুফ (আ.) কা চেহারা ইছিমে আয়া হ্যায়। উসকো আজিজ রাখো। মাইনে উসকা নাম গোলাম রহমান রাখহা।” অর্থাৎ এ শিশু আমার বাগানের গোলাপ ফুল। হযরত ইউসুফ (আ.)’র রূপ-লাবণ্য তার মধ্যে এসেছে। তাকে যত্ন করিও। আমি তার নাম গোলামুর রহমান রাখলাম।” ছয় বছর বয়সে শিশু গোলামুর রহমানের হাতেখড়ি হয়েছিল পিতৃব্য গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) হাতে। পঁচিশ বছর বয়সে জামায়াতে উলার ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার তৃতীয় দিনে পরীক্ষার কাগজ-কলম দূরে নিক্ষেপ করে বলতে লাগলেন ‘আসিয়াছেন আপনি, আসিয়াছেন আপনি, কষ্ট স্বীকার করিয়া কেন আসিলেন? আমি মাথায় হাঁটিয়া আপনার খেদমতে হাজির হইতাম।’ শুরু হল প্রেম সাগরের অগ্নি পরীক্ষা। খাজা গরিবে নেওয়াযের ভাষায়-প্রেম এমন এক অগ্নি যা কিছু এর মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে, সেসবই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেবে। এ অবস্থাতেই এসে হযরত রাবেয়া বসরী আগুন-আগুন বলে চিৎকার করতে লাগলেন। বসরার লোকজন চিৎকার শোনে পানি ভর্তি পাত্র সঙ্গে নিয়ে আগুন নেভানোর জন্য দৌড়াতে লাগলেন। একজন বুজুর্গ পথিমধ্যে তাদের পথরোধ করে বুঝালেন, রাবেয়ার আগুন পৃথিবীর আগুন নয়। ঐ আগুন ইশ্কে ইলাহির আগুন, দুনিয়ার কোন বস্তুতেই নেভানোর নয়। রাবেয়ার অন্তরে ইলাহির প্রেমের প্রখরতা এত প্রবল হয়েছে যে, এখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন এ আগুন প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলনের আগে আর নেভানোর নয়। হযরত মনসুর হাল্লাজকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল, প্রেমের পরিপূর্ণতা কী? উত্তরে বললেন, “কেউ যখন প্রেমাস্পদের মোশাহেদায় ইলাহির নূরের দর্শনে এমনভাবে নিবিষ্ট থাকে যেন তাকে মারুক-কাটুক তবুও তার তন্ময়তায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় না। তাহলে (তখন) তাকে আশেকে কামেল বা পরিপূর্ণ প্রেমিক বলা চলবে”। গাউসুল আযম বিল বিরাসত মওলানা শাহ্ সূফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.) দিনের পর দিন আহার না করে শীতের ঠান্ডা হাওয়াকে উপেক্ষা করে নিজ মুর্শিদের চরণের পানে অনবরত তাকিয়ে থাকতেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। মাঝে মাঝে পবিত্র চরণ ধরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। পবিত্র চরণ থেকে জোরপূর্বক কেউ নিয়ে গেলে ‘ছাড়িয়া দাও, দেখিতে দাও, আমার প্রাণ যায়’ বলে চিৎকার করে চৈতন্যহীন হয়ে পড়তেন। তিনি জালালিয়ত বা ভাব-বিভোর অবস্থায় থাকলে মানুষকে প্রায়শ আঘাত করতেন। একবার হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর আত্মীয় ও ফয়েজপ্রাপ্ত খলিফা হযরত আবদুল মজিদ মিঞাকে মজলিশে থাকা অবস্থায় বাতির থাক দিয়ে প্রহার করার পর তিনি গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর সামনে গেলে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী তাকে বললেন- ‘ভাই, উহ্ সাহেবে জালাল হ্যায়। মুলকে এমন মে রাহতা হ্যায়, আলমে আরওয়াহ্ মে সায়ের করতা হ্যায়। আপ তো হামারা ছাত রহিয়েগা, উনকে পাস কেউ গেয়া?’ অর্থ- ভাই, সে হাল জজবায় বিভোর ছিল। তাই মজলিশে থাকা আলমে আরওয়ায়ে সফর করছে’। অর্থাৎ পার্থিবতা হতে দূরে অতি উর্ধ্বের মকামে বা স্তরে বিচরণ করছেন। বয়স পঁচিশে থাকাকালীন সময়ে তাঁকে একটি চোগা বা জুব্বা পড়িয়ে দিয়েছেন গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)। তিনি স্বীয় মুর্শিদকে প্রাণাধিক ভালবাসতেন এবং মুর্শিদও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এমনকি স্বীয় মুর্শিদ গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর  বেসালের পরও সেই ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সর্বদা তাঁর রওজা শরিফে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

একবার নিজ মুর্শিদ গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) কদম মোবারক দুই হাতে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন কোন প্রকারেই ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অতঃপর স্বীয় মুর্শিদ জজবার হালতে চেয়ারের হাতল দ্বারা প্রহার করতে করতে সুন্দর বদনখানি রক্তাক্ত করে দিলেন এবং চেহারার দিকে তজল্লী দিয়ে বলতে লাগলেন “ইউসুফের মত সুন্দর দেখিতেছি, যেন ইউসুফের মত সুন্দর দেখিতেছি”। এমতাবস্থায় তিনি হযরত সাহেবানীর সুপরামর্শে দরবার শরিফ ত্যাগ করে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর তথা নির্জনতাকে নিত্য সঙ্গী করে ১২ বৎসর কঠোর সাধনার পর দরবার শরিফে স্বীয় মুর্শিদের ওফাতের ষষ্ঠ মাসে আষাঢ়ের বর্ষায় সাম্পানযোগে ফিরে আসেন। এত কষ্টের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল স্বীয় মুনিবের প্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সন্তুষ্টি অর্জন করা। যদিও মানুষের কাছে এই কষ্ট ভয়াবহ ছিল কিন্তু তাঁর কাছে চুল পরিমাণও কষ্ট মনে হল না। তাই তো ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন, বাগদাদের বাজারে এক ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে কেটে দিল। কিন্তু সে কাঁদল না বরঞ্চ হাসছিল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তোমাকে এত আঘাত করার পরও না কেঁদে হাসছ কেন?’ সে উত্তর দিল, ‘ঐ সময় বন্ধুর দর্শনে বিভোর ছিলাম, আমি সামান্যতম কষ্টও অনুভব করিনি’।

গাউসুল আযম বিল বিরাসত মওলানা শাহ্ সূফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারীকে হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী আদর করে ‘বাচা ময়না’ বলে ডাকতেন। তিনি গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) খলিফায়ে আযম ও ত্বরিকায়ে মাইজভাণ্ডারীয়ার দ্বিতীয় মহান শায়খ এবং ত্বরিকার অন্যতম প্রচারক ছিলেন। তিনি ‘কুতুবুল আকতাব’ এবং ‘গাউসুল আযম বিল বিরাসত’ সুলুকের অলিউল্লাহ্ ছিলেন। তিনি আপন মুর্শিদের প্রতি যে ভালবাসা প্রদর্শন করেছেন তা ত্বরিকত জগতে উদাহরণ হিসেবেই থাকবে। নিঃসন্দেহে তিনি গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) অন্যতম কারামতও বটে। গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর অন্যান্য খলিফাগণের নিকটও গাউসুল আযম বিল বিরাসত মওলানা শাহ্ সূফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছিলেন অকৃত্রিম ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার স্থল। আল্লামা মকবুলে কাঞ্চনপুরীর ‘আয়নায়ে বারী ফি তরজুমাতি গাউসিল্লাহিল আযম মাইজভাণ্ডারী’তে (২ বার), আল্লামা ফরহাদাবাদীর ‘আত্ তওজিহাতুল বহিয়্যাহ্ ফি-তরতিদে মা-ফিত্ তানকিহাতিস সুন্নিয়াহ্’ এবং আল্লামা মন্দাকিনীর ‘প্রেমের হেম’ কিতাবে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তাঁর অত্যন্ত স্নেহের কনিষ্ঠা শাহজাদী সৈয়দা সাজেদা খাতুনকে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর অছি ও গদিনশিন মওলানা শাহ্ সূফি হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর (ক.) নিকট বিবাহ প্রদান করে তদীয় পীর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) পরিবারের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন নিশ্চিত করেন। কিংবদন্তি আছে, এই বিবাহ গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) বরকতময় ইশারায় হয়েছিল। তিনি অছিয়ে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর পীরে তাফায়্যুজ ছিলেন। উল্লেখ্য, শেষ জীবনে প্রায় ২৩ বছর যাবৎ নিজ জবানকে নির্বাক করে রেখেছিলেন তিনি। অবশেষে অসংখ্য কারামতের সেই কেন্দ্র ১৯৩৭ সালের ৫ এপ্রিল মোতাবেক ২২ চৈত্র  বেসালপ্রাপ্ত হন।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

লেখক: প্রাবন্ধিক।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.