রমা চৌধুরীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠানো এবং তাঁকে রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের আহবান

0 350

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের কাছে হারিয়েছেন সম্ভ্রম। হানাদারের গান পাউডার দিয়ে লাগিয়ে দেয়া আগুনে পুড়েছে ঘরবাড়ি স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পদসহ সকল সৃষ্টিশীল কর্ম। যুদ্ধের কারণে হারিয়েছেন দুই শিশু পুত্র। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি পথে পথে নিজ সন্তান এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মরণে খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই ফেরী করেছেন। স্বাধীন দেশের মাটিতে শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা সয়ে নিজের আত্মসম্মানে বলিয়ান হয়ে রুগ্ন-ক্লিষ্ট শরীরেও কারো দয়ার মুখাপেক্ষী না হয়ে মাথা উঁচু করে কীভাবে বাঁচতে হয় দেখিয়ে গেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর নিজের অন্য দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে শহীদ দুই সন্তানের স্মৃতির উদ্দেশে গড়তে চেয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য অনাথালয়। উনিশশো আটানবব্বই এর ষোল ডিসেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় হারান একুশ বছরের কনিষ্ঠ সন্তান দীপংকরকে। সব শোক দুঃখ সয়ে কঠিন এক সংগ্রামী জীবন যাপনকারী একজন রমা চৌধুরী রাষ্ট্র, সমাজ এবং দেশবাসীর কাছে কিছুই চান নি। আমাদের দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের কর্ণধার কেউই তাঁকে উল্লেখযোগ্য কিছু দিতে পারে নি। একজন রমা চৌধুরী তাঁর নির্লোভ সংযমী মানসিক দৃঢ়তায় কিছুটা অভিমান আর কষ্ট নিয়ে সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারো সাহায্য সহযোগিতা কিংবা খেতাব সম্মাননা নেন নি। এমনকি দীর্ঘবছর অসুস্থ অবস্থায়ও কারো দান নিতে ছিলেন অপারগ। তাঁর মৃত্যুর পরে সরকার তাঁকে দেন “মরণোত্তর বেগম রোকেয়া পদক”! একজন রমা চৌধুরী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেনো পরস্পর এক সূত্রে গাথা এক কাহিনি অথচ বাংলার মুক্তিসংগ্রাম কিংবা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের নথি কিংবা গেজেটে আজো একজন রমা চৌধুরীর নাম লিপিবদ্ধ হয়নি। এ এক লজ্জার কথা। রমা চৌধুরী তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ “একাত্তরের জননী”তে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নির্যাতন সংগ্রামের বিস্তারিত লিখেছেন। সে বই সয়ং প্রধানমন্ত্রীর হাতেও  পৌঁছেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সাথে রমা চৌধুরী সাক্ষাৎ করে আসবার পরে দীর্ঘ পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীকে কিছু দিতে পারেননি। সেই নিয়ে মিডিয়ায় বহু তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু একজন রমা চৌধুরী যে তাঁর সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে শত শত সন্তান পালনের ইচ্ছায় একটি অনাথ আশ্রম গড়তে চেয়েছিলেন সেই স্বপ্নের সারথি তো প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার নির্দেশিত কোন মন্ত্রণালয় নিতেই পারতো। রমা চৌধুরী চলে গেছেন মাথা উঁচু করে কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা এখনো করা যায়। এখনো রমা  চৌধুরীর জীবন ও কর্ম মানুষের কাছে তুলে ধরার সুযোগ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আছে। রমা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে তো বোন ডেকেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কি সেই বোনের জন্য কিছুই করবেন না? রমা চৌধুরী বেঁচে নেই কিন্তু তাঁর স্বপ্নের অনাথ আশ্রম এবং তাঁর পৈতৃক ভিটা মাটি এখন বেহাত, বেদখল হওয়ার অপচেষ্টা চলছে। রমা  চৌধুরীর জীবিত একমাত্র সন্তান জহর লাল যে মায়ের সাথে সাথে সকল দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে এখন দীর্ঘদিন রোগে শোকে বিনাচিকিৎসায় মায়ের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের পোড়া ভিটের স্মৃতি, শহীদ ভাইদের সমাধী আগলে পড়ে আছে। রমা চৌধুরীর এই একমাত্র উত্তরাধিকারীকে বাঁচিয়ে রাখা রমা চৌধুরীকে বাঁচিয়ে রাখার মতই। বাংলার মুক্তিসংগ্রাম এবং এই সংগ্রামে একজন রমা চৌধুরীর অবদান আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তাঁকে অন্তত মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নথিবদ্ধ করে। তাঁর উত্তরাধিকারীকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান করে। দেশের এবং সরকারের কিছুটা ঋণ অন্তত লাঘব করা যায়। একাত্তরের জননী সাহিত্যিক রমা চৌধুরীর মৃত্যুর পরে আমরা কয়েকজন তরুণ মিলে রমা চৌধুরী স্মৃতি সংসদ গড়ে তুলেছি রমা চৌধুরীকে মৃত্যুর পরেও বাঁচিয়ে রাখবো সেই আশায়। আমরা চেয়েছি তাঁর স্বপ্ন দীপংকর স্মৃতি অনাথালয় গড়ে তুলতে। আমরা চেয়েছি তাঁর রচিত সৃষ্টিশীল ১৮ টি গ্রন্থ পুনঃপ্রকাশ করে সকল পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তারই লক্ষ্যে রমা চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন এবং একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে আমরা সেই কাজ বেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছি।

রমা চৌধুরী স্মৃতিসংসদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের দাবী (১) রমা চৌধুরীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে  গেজেটে নাম প্রকাশ করা হোক। (২) তাঁর প্রাপ্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তাঁর উত্তরাধিকারী একমাত্র জীবিত সন্তান জহর লালকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।  (৩) রমা চৌধুরী স্মৃতি সংসদ বা স্মৃতি মন্দির এবং অনাথালয় গড়ায় সরকার এবং মন্ত্রাণালয় এগিয়ে আসুক। (উল্লেখ্য, রমা চৌধুরীর মৃত্যুর পরে বোয়ালখালীর ততকালীন সাংসদ বাদল সাহেব রমা চৌধুরীর সমাধীর সামনে কথা দিয়েছিলেন রমা চৌধুরীর নামে তাঁর বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স করে দেবেন। তিনি তো এখন গত হয়েছেন তাঁর উত্তরসূরী বর্তমান সাংসদও তো রমা চৌধুরীর পরিচিত কাছের জন ছিলেন। তিনি তো সেই উদ্যোগ নিতে পারেন)  (৪) রমা চৌধুরীর প্রকাশিত অপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহ প্রকাশ করে (রমা চৌধুরীর ইচ্ছে অনুযায়ী) তাঁর স্বপ্নের অনাথ আশ্রমের খরচ  জোগানের জন্য ব্যবস্থা করতে সকলের সহযোগিতা।  (৫) রমা চৌধুরীকে সরকারি সর্বোচ্চ সম্মান “স্বাধীনতা পদক” অথবা “একুশে পদকে” ভূষিত করা।  (৬) কালুর ঘাট সেতুর নাম “একাত্তরের জননী রমা চৌধুরীর” নামে নামকরণ করা হোক। (৭) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর আওতায় রমা চৌধুরীর নামে একটি গণগ্রন্থাগার করা হোক।  (৮)  সর্বোপরি রমা চৌধুরীর প্রিয় জায়গা তাঁর বাসস্থান লুসাই ভবনের রুমটি যা তাঁর স্মৃতি সংগ্রহশালা হিসেবে সংরক্ষণের জন্য সকলকে এগিয়ে আসা। রমা চৌধুরী স্মৃতি সংসদ গত ছাব্বিশ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে রমা চৌধুরীর অবদান শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠানে অতিথি ও বক্তাদের বক্তব্যে উপরিউক্ত বিষয়াবলি উঠে আসে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানানো হয়। সংসদের অস্থায়ী কার্যালয় লুসাই ভবনের ৪র্থ তলায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংসদের আহবায়ক আলাউদ্দিন খোকনের সভাপতিত্বে সদস্যসচিব শামসুজ্জোহা আজাদের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার কর্মী নবাব হোসেন মুন্না, মানবাধিকার কর্মী তানছির এবং সংগঠনের সদস্য যথাক্রমে এইচ এম স্বপন, শরিফুল ইসলাম,  মো. হালিম, এহছান, ডা. জলিল, সিক্তা শিমুসহ অনেকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একজন রমা চৌধুরীকে এই সম্মানে ভূষিত করলে দেশ সরকার এবং রমা চৌধুরীর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

আলাউদ্দিন খোকন

আহবায়ক, রমা চৌধুরী স্মৃতি সংসদ

Leave A Reply

Your email address will not be published.