মাহে শা’বান ও লাইলাতুল বারা’আতের ফজিলত

1 470

লাইলাতুল বারা’আতের কারণে শা’বান মাসের গুরুত্ব আমাদের নিকট অনেক বেশি। মুসলিমদের অনেকে এই ব্যাপারে একবারেই উদাসীন।কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর যথার্থ বিশ্লেষণ নিম্নে দেয়া হলো:-

রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে সুরা দোখানের ৪ নম্বর আয়াতে বলেন:-এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। এ আয়াতে রাত বলতে শা’বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বুঝায়।

হযরত ইকরামা (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন আল্লাহর এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে ওই রাত যা শা’বান মাসের মধ্যবর্তী।

হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন. নবী কারীম (দ.) ইরশাদ করেন আল্লাহ তা‘আলা ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ই শা‘বানের রাতে সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান-৫৬৬৫, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ-৩/৩১৫)

হযরত ইকরামা (রা.) ইবনে আব্বাস(রা) হতে নবী করীম (দ.) সূত্রে বর্ণনা করেন হুযুর (দ.) ইরশাদ করেন রজব আল্লাহর মাস, শা’বান আমার মাস, রমজান আমার উম্মতের মাস।

হযরত আবু হুরায়রা(রা.) হতে বর্ণিত নবী করীম (দ.) এরশাদ করেছেন, শা’বান আমার মাস, রজব আল্লাহর মাস, এবং রমাদান আমার উম্মতের মাস।শা’বান সকল গুনা দূরীভূত করে, রমজান সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করে। হুযুর (দ.) এরশাদ করেন রজব মাস এবং রমজান মাসের মধ্যবর্তী শা’বান মাস মানুষ যাতে অবহেলা করে কিন্তু এই মাসে বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। আর আমি পছন্দ করি আমার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে এমতাবস্থায় উপস্থাপিত হউক যখন আমি রোজাদার।

হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল পাক (দ.) আরও এরশাদ করেন রজব মাসের ফজিলত সকল মাসের মধ্যে এমন যে যেমন আল্লাহর সমস্তকিতাবসমূহের মধ্যে কোরআন শরীফের ফজিলত। এবং শাবান মাসের ফজিলত হচ্ছে এমন যে যেমন সকল প্রেরিত নবীগণের মধ্যে আমি-ই-উত্তম / শ্রেষ্ঠ। আর রমজান মাসের ফজিলত সমস্তসৃষ্টির মধ্যে যেমন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ।

হযরত আনাস (রা) আরো বর্ণনা করেন যে,রাসূলে করীম (দ.) এর সাহাবাগণ যখন শাবান মাসের চাঁদ দেখতেন তখন কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য দিওয়ানা হয়ে যেতেন এবং মুসলমানগণ নিজে নিজে মাল যাকাত দিতেন যেন মিসকিন এবং গরিব মুসলমগণ রোজা রাখার জন্য কোন কষ্ট করতে না হয়। এবং বিচারক সকল কয়েদিদেরকে ডাকতেন সাজাপ্রাপ্তদেরকে শাস্তি নির্দিষ্ট করে বাকি সবাইকে খালাস দিতেন। সওদাগররা কর্জ উঠাইয়ে নিতেন দেনাদারও তা পরিশোধ করতেন আর যখন রমজানের চাঁদ দেখতেন তখন ইতেকাফে বসে যেতেন।

আরবিতে শা’বান লিখতে পাঁচটি অক্ষর ব্যবহৃত হয়। যথা ১.সীন,সারফূন অর্থ মর্যাদা। ২.আইন, উলূঊন অর্থ উচ্চ।৩. বা, বিরুন অর্থ কল্যাণ। ৪.আলীফ, উলফাতুন অর্থ প্রেম। ৫.নূওন, নূরুন অর্থ জ্যোতি বা আলো।এই মাসের ৫টি হরফ এবং তার ফজিলত স্বয়ং রাব্বুল আলামিনের দরবার থেকে নির্দিষ্ট হয়। এই মাসে নেকির দরজা খোলা হয়। বরকত নাযিল হয়, গুনাহ মাপ করা হয়। এ মাসে রাসূল করীম (দ.)এর উপর বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়ার প্রয়োজন। (গুনিয়াতুত তালেবীন কৃত:-আব্দুল কাদের জিলানী)

রাসূল (দ.) ইরশাদ করেন -এই মাসের শেষ সোমবার যে রোজা রাখবে তার সমস্তগুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে কারীম (দ.) বলেছেন, মাসটিকে এই জন্যই শা’বান নাম রাখা হয়েছে যে, এই মাসে রমজানের জন্য বেসুমার নেকি বণ্টন করা হয় এবং রমজানকে রমজান এজন্য নাম রাখা হয়েছে যে, এই মাসে সকল গুনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

হযরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল করীম (দ.)এরশাদ করলেন শা’বানের (১৪ তারিখ দিবাগত) রাত্রে জিবরাঈল আ. আমার কাছে এসে বললেন,হে আল্লাহর রসূল আসমানের দিকে নিজের মাথা মোবারক উঠান! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কোন রাত? তিনি বললেন: এটা ওই রাত, যে রাতে আল্লাহ তাআলা রহমতের তিনশত দরজা খুলে দেন তাঁর ওই বান্দাদের জন্য যারা শিরিক করেনা, যারা যাদু টোনা কারী নয়, সুদখোর নয়, যেনাকারী নয়,মদ্যপানকারী নয়, যদি না তারা আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে তওবা করে। যখন রাত্রে চতুর্বাক হল জিব্রাইল (আ) আবার এলেন এবং বললেন হে আল্লাহর রসূল আকাশের দিকে তাকান। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন এবং জান্নাতের সকল দরজাগুলো খোলা দেখলেন। প্রথম দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলতে লাগল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে রাত্রি জেগে এবাদত করে। দ্বিতীয় দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে আল্লাহর দরবারে সেজদারত। তৃতীয় দরজা থেকে এক ফেরেশতা ডেকে বলল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে আল্লাহর দরবারে মোনাজাতে রত। চতুর্থ দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে এই রাত্রিতে জিকিরে রত। পঞ্চম দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটিতে রত। ষষ্ঠ দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে খাঁটি মুসলমান। এবং সপ্তম আসমানের দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বলতে লাগল সুসংবাদ ওই বান্দার জন্য যে আল্লাহর কাছে চাইবে। অষ্টম দরজা থেকে একজন ফেরেশতা ডেকে বললেন আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার কেহ আছো কি? আজ সকলের গুনা ক্ষমা করা হবে। রাসূল (দ.) বললেন হে জিবরাঈল এই দরজাগুলো কখন পর্যন্ত খোলা থাকবে? তিনি বললেন রাত্রির প্রথম অংশ থেকে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত! অতঃপর তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসূল নিশ্চয় দোযখ থেকে পরিত্রাণ প্রাপ্তগণের সংখ্যা হবে “খলব” গোত্রের ছাগলের পালের সকল ছাগলসমূহের কেঁশসমূহের সমান।

এই মাসে অসংখ্য নফল নামাজ ও নফল রোজার কথা হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে , বিশেষ করে এ মাসের ১৩-১৪-১৫ তারিখের রোজা। শা’বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রি যাকে আমরা শবে বারা’আত বলে থাকি। এ রাত্রে অনেক নফল নামাজের কথা রয়েছে। গুনিয়া কিতাবে বর্ণিত এই রাত্রিতে ১০০ রাকাত নফল নামাজ রয়েছে যাকে “সালাতুল খায়ের” বলা হয়। প্রতি রাকাতে ১০ বার সূরা ইখলাস সূরা ফাতিহার পরে পড়তে হয়। তাবরানী, বাইহাকী শরীফ, ইবনে মাজা, ইবনে হিব্বান, মুসলিম, বুখারী, কিতাবসমূহে বর্ণনা রয়েছে।

আবু দাউদের একটি বর্ণনায় এমন রয়েছে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন রাসূল (দ.) এর কাছে রোজা রাখার জন্য প্রিয়তম মাস ছিল শাবান। তারপর এর সাথেই তিনি রমজানের রোজা মিলিয়ে নিতেন।

বুখারী ও মুসলিমের এক বর্ণনায় রয়েছে হযরত আয়েশা রা.বলেন: রাসূল (দ.) কোন মাসেই শা’বানের চেয়ে অধিক রোজা রাখতেন না। কেননা তিনি পূর্ণ শা’বান রোজা রাখতেন। আর তিনি বলতেন তোমরা এমন আমল ই করো যা করার তোমাদের শক্তি রয়েছে। কেননা আল্লাহ ক্লান্ত হবেন না তোমরাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

হযরত আলী (রা.) থেকে নবী করীম (দ.) সূত্রে বর্ণিতঃ তিনি বলেন মধ্য শা’বানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা রাত্রি জাগরণ কর এবং এই রাতের পর দিন রোজা রাখ। কেননা মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর এই রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন: কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোন রিযিক প্রার্থী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দেব। কোন বিপদগ্রস্ত আছো কি? আমি তাকে শান্তি দেব। এভাবে ফজর পর্যন্ত তিনি ডাকতে থাকেন। (হাদীসটি ইবনে মাজা বর্ণনা করেছেন।)

মোটকথা শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রি সারারাত জেগে ইবাদত এবং পরদিন রোযা রাখা সরকারে দো আলম নূরে মুজাসসাম রাহমাতুল্লিল আলামিন হতে শুরু করে আমাদের শেষ আকাবেরিনগণ কর্তৃক অনুমোদিত।

ইমাম আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (র.) তার দিওয়ানে আজিজ কিতাবে লিখেছেন হে যুবক বরকতময় রাতগুলোতে নফল নামাজগুলো জামাত সহকারে সম্পন্ন করা যায়।

ওই রাত্রে নিঃসন্দেহে হালুয়া পাকানো যায়েজ। কারণ ওই রাত্রে গোটা বছরের ভাগ্য বণ্টন করা হয়। ওই রাত্রে ফাতিহা ও কবরগুলোর জিয়ারতের উত্তম রাত্র সাব্যস্তহয়েছে ওহে বিবেকবান গণ।

পরিশেষে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ উক্ত মর্যাদাময় রাত্রিতে তাহারি এবাদতে আমরা যেন মশগুল থাকতে পারি আমিন। ছুম্মা আমিন। বিহূর্মতে সৈয়েদুল মুরসালিন। বিতুফাইলে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী কাদ্দাসাল্লাহুল ছির্রাহুল আমিন।

লেখক, এস এম এম সেলিম উল্লাহ

মাইজভাণ্ডারী গবেষক

 

 

 

1 Comment
  1. এস এম এম সেলিম উল্লাহ says

    লেখাটা সুন্দর হয়েছে, অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.