শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ চান বাপ্পী দেব বর্মন

0 298
সংগ্রামী নারী বাপ্পী দেব বর্মন

বয়স তখন সবেমাত্র ৯-১০ বছর, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। সংসার চালাতে বাবা কাজ করে চলেছেন দিন-রাত। কেঁদে উঠলো বড় মেয়েটার মন। বাবাকে সাহায্য করতেই হবে। অগত্যা বিদ্যালয়ে না গিয়ে সোজা পোশাক কারখানার সামনে। কিন্তু এটুকুন মেয়েকে কে দেবে চাকরি?

নিজের জীবনের গল্প এভাবেই শুরু করলেন শৈশব থেকেই সংগ্রামী নারী বাপ্পী দেব বর্মন। তিনি এখন আলোকিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।

বাপ্পী দেব বর্মন বলেন, চট্টগ্রাম শহরের পি কে সেন সাততলায় আমার জন্ম। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন তন্বী নামে। ৩ ভাই-৩ বোনের খরচ যোগাতে বাবার হিমশিম অবস্থা। তাই নিয়েছিলাম চাকরি করার সিদ্ধান্ত।

একদিন সকালে অভয়মিত্র ঘাট এলাকার সিজন অ্যাপারেলস কারখানার সামনে চলে গেলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাড়োয়ান এসে জানতে চাইলেন-কেন এসেছি। বললাম, চাকরি করবো।

অট্টহাসি দিয়ে তিনি বললেন-তুমি ছোট মেয়ে, এখনও চাকরি করার বয়স হয়নি, চলে যাও। আমিও ছাড়বার পাত্রী নই। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম গেটের সামনে। কিন্তু দাড়োয়ানের মন গলেনি। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম সেদিন।

তার ভাষায়, পরদিন সকালে আবারও গেলাম সেই কারখানার সামনে। তবে একটু নতুন রূপে। আগের দিনের জীর্ণ ফ্রক ছেড়ে ফুল প্যান্ট, ফ্রকের ওপর ওড়না, কপালে টিপ ও হাতে চুড়ি, চুলে বেণি। আমাকে দেখে দাড়োয়ান ভ্রু কুঁচকালেন। ঠিকই চিনতে পারলেন।

২-৩ ঘন্টার অপেক্ষা শেষে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ওই কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাছে। আমার অনুরোধে তিনি সেখানে কাজের সুযোগ দিলেন। হাতে তুলে দেওয়া হলো কাপড় কাটার কাঁচি।

ওই কারখানায় এত মানুষ আর বড় বড় মেশিন দেখে একটু ভড়কেই গেলাম। এক অপারেটরের পাশে দাঁড়িয়ে মেশিন থেকে বের হওয়া কাপড়ের সুতো কাটার দায়িত্ব পড়লো।

১ম দিন, অচেনা পরিবেশ, কাজও নতুন। তাই ধমক খেলাম অপারেটরের। অপমান বুকে চেপে তবুও কাজ করতে লাগলাম।

‘এভাবে কেটে গেলো ৩ মাস। প্রতিমাসে বেতন জুটতো ২৮০ টাকা। কিছু টাকা দিতাম পিশির হাতে। তিনি মার্কেটে গিয়ে আমাকে নতুন জামা কিনে দিলেন। মায়ের হাতে দিতাম ১শ টাকা। কিন্তু সে কাজে আর লেগে থাকা হলো না।

খবর পাই, শিক্ষকরা আমাকে খুঁজছেন। বান্ধবী আমার হয়ে নানান মিথ্যা বলে। অসুস্থ থাকার কথা জানায়। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। আমার কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলেন বাবার পরিচিত।

তার মাধ্যমে বাবা জেনে যান আমার চাকরির খবর। অগত্যা বেদম পিটুনি খেয়ে ৩-৪ দিন বিছানায়। চাকরিটা ছেড়ে আবারও স্কুলে। সেখানেও রেহাই মেলেনি। তিন মাস না আসার অপরাধে আবারও পিটুনি’।

প্রাইমারি পাস করে জেএমসেন স্কুলে পড়ালেখা শুরু হয় বাপ্পীর। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে সদরঘাট এলাকার রাজ হোটেল সংলগ্ন গার্মেন্টে আবারও চাকরি শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে আজিম গ্রুপের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেন বাপ্পী দেব বর্মন।

সঙ্গে চলতে থাকে পড়ালেখাও। আজিম গ্রুপে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা ছিল। সেখানেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার হাতেখড়ি। ১৯৯৬ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

২০০৩ সালে স্বামীর হাত ধরে বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনে যোগ দেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত চাকরির পাশাপাশি চালিয়েছেন সাংগঠনিক কার্যক্রম।

এসময়ে দেশের প্রায় সব জেলা ঘুরে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের দাবি আদায়ে সংগ্রাম করেছেন। বিলস, আইএলওসহ বিভিন্ন সংস্থার সেমিনার-ওয়ার্কশপ-মিটিং এ বলেছেন তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা।

কয়লা শ্রমিক, চিংড়ি চাষি, চা শ্রমিক, অভিবাসন শ্রমিক ও শিশু শ্রমিকদের কষ্ট তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাই অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সেই ভাবনা থেকেই যাত্রা শুরু হয় আলোকিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রেশন পায় সংগঠনটি।

ঢাকার মিরপুরে প্রধান কার্যালয় এবং ২০২১ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে শাখা কার্যালয় নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান বাপ্পী দেব বর্মন। এরপর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ।

করোনাকালে পাঁচ শতাধিক গার্মেন্ট শ্রমিকের পরিবারে এই সংগঠন পৌঁছে দিয়েছে ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী। এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট, জেলা পরিষদ সহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় অসহায় শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে এই সংগঠন।

নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার সংগঠনের মাধ্যমে নির্যাতিত কয়েকজন নারীকে আইনগত সহায়তাও দেওয়া হয়েছে।

বাপ্পী দেব বর্মন বলেন, করোনাকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য দুর্যোগই বয়ে এনেছে। অনেকের চাকরি গেছে। করোনার টিকা নিবন্ধন ওয়েবসাইটে গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য কোনও অপশনই রাখা হয়নি।

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ মতে, নারী শ্রমিকদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা দুই-ই বেড়েছে। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা তেমন বাড়েনি।

পোশাকশিল্প খাতে ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ নারী শ্রম দিচ্ছেন। দিন শেষে তাদের জমার খাতা শূন্যই থাকছে।

তিনি বলেন, আলোকিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন শ্রম আইন ২০০৬ এর যথাযথ বাস্তবায়ন চায়। আমরা মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কোন্নয়নে বিশ্বাসী। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে আমরা কখনো পিছপা হবো না।

আমরা শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ চাই। এই সংগঠনের স্বপ্ন- বয়স্ক শ্রমিক নিবাস, প্রসূতি শ্রমিকদের পরিচর্যা কেন্দ্র ও চাইল্ড কেয়ার হোম প্রতিষ্ঠা। শ্রমিকদেরও বিনোদনের প্রয়োজন। তাদের প্রতিভা অন্বেষণের সুযোগ দেওয়া দরকার।

প্রত্যেক কারখানায় গিয়ে এমন প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করতে চাই আমরা। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দরকার সমাজের বিত্তবান ও চিত্তবানদের সহায়তা এবং সমর্থন। আমার বিশ্বাস, এই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, শ্রমিকরা পাবে সুন্দর কর্মপরিবেশ।

আবীর চক্রবর্তী : লেখক ও সাংবাদিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.