আহমদ মমতাজের মৃত্যু সংবাদ শুনে

0 609
কবি মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন ও আহমদ মমতাজ

লেখক, গবেষক ও বন্ধু আহমদ মমতাজ আর নেই। সকালে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো- একজন খুব কাছের মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো কাল করোনা আমাদের কাছ থেকে। তাঁর সাথে পরিচয় তিন দশক আগে। প্রথম পরিচয় প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষে-পত্রের মাধ্যমে। পত্রটা পাঠিয়েছিলেন তিনি – মিরসরাই সংক্রান্ত তাঁর একটি বইয়ের জন্য সহযোগীতা চেয়ে। সহযোগীতা বলতে আমার জানা মিরসরাই সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করা। করেছিলামও। তবে তিনি যতটুকু প্রত্যাশা করেছিলেন ততটুকু হয়তো করতে পারিনি, কারণ তখন আমি বৈষয়িক বাস্তবতা ও আমার একটি বই নিয়ে বেশিরকম ব্যস্ত ছিলাম।

প্রত্যক্ষ পরিচয়টা হয়েছিলো চট্টগ্রামে- কোনো এক সাহিত্য সভায়। তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আলোকিত আয়োজনে দেখা হতো তাঁর সাথে, আলাপ হতো সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে। তাঁর জন্ম উপজেলা মিরসরাই হওয়ায় মিরসরাই-এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলো তাঁর অপার। চট্টগ্রামও তার বাইরে ছিলোনা। চট্টগ্রাম ও মিরসরাই-এর ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও মনীষা নিয়ে লেখার প্রতি ছিলো তাঁর অসম্ভব আগ্রহ। সে সংক্রান্ত কোনো তথ্যের সন্ধান পেলে যতদূরই হোকনা কেন, দেরি নেই ; কাঁধে কাপড়ের বেগ ঝুলিয়ে চলে যেতেন সেখানে। বেগে থাকতো একটি নোট বই, কলম, ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার। নিজেই ছবি তুলতেন, টেপরেকর্ডারে সংশ্লিষ্ট জনদের সাক্ষাৎকার নিতেন, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা মতামত সংক্ষেপে নোট করে নিতেন। পরে এসবের আলোকে এবং বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স সহযোগে বিভিন্ন বিষয় ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর পত্র-পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে লিখতেন। তাঁর লেখা শুধু বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়ই নয়, বিদেশের, বিশেষ করে ভারতের পত্র-পত্রিকায়ও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো। তাঁর বেশির ভাগ লেখাই হতো তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণধর্মী। সেকারণে তাঁর লেখা হয়ে যেতো দীর্ঘ। দীর্ঘ হলেও সেসব লেখা কাটছাঁট ছাড়াই প্রকাশ পেতো পত্র-পত্রিকায়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পত্র-পত্রিকায়। তাঁর এজাতীয় অসংখ্য লেখা ছাপা হয়েছে চট্টগ্রামের আজাদী ও পূর্বকোন পত্রিকায়। আজাদী’র অরুণ দা (অরুণ দাশগুপ্ত), সিদ্দিক ভাই (সিদ্দিক আহমেদ) কোথাও দেখা হলে আহমদ মমতাজের কথা জিজ্ঞেস করতেন। সিদ্দিক ভাই তো শুধু দেখা হলেই নয়, আমাকে ফোন করলেও আহমদ মমতাজের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন এবং তাঁর লেখার প্রশংসা করতেন।
তাঁকে নিয়ে কত স্মৃতি মনে পড়ছে এমুহূর্তে! সবকিছু লিখতে গেলে আস্ত একটি বই হয়ে যাবে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধ পরিসরে এবং স্বল্প সময়ে সেটা সম্ভব নয় বিধায় সামান্য কিছু স্মৃতি এই অক্ষম লেখায় তুলে ধরার কোশেশ করছি।

মনে পড়ে, তিনি যখন চট্টগ্রামের সুফী-সাধক নিয়ে বই লিখতে মনস্থ করেছিলেন, চিঠি লিখে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (র.) সম্পর্কে তথ্য পাঠাতে। আমি মওলানা সংক্রান্ত প্রকাশনা ও প্রামাণ্য দলিলাদি যা যা আমার কাছে ছিলো, সবকিছুই কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিই তাঁর ঠিকানায়। শুধু মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (র.)-ই নয়, মিরসরাই তথা চট্টগ্রামের আরেক গৌরব প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, লেখক ও উর্দু কবি (ছদ্ধ নাম ‘তনহা নিযামী) মওলানা মুতিউর রহমান নিযামী (র.)[প্রাক্তন প্রধান মুহাদ্দিস, দারুল উলুম আলীয়া, চন্দনপুরা চট্টগ্রাম) সম্পর্কেও তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাঁর সেই অনুরোধেও সাড়া দিয়ে প্রয়োজনীয় ও প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত তাঁর ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম। বইটি বের হলে দেখি, সেসব তিনি কাজে লাগিয়েছেন। তখন বইটির একটি প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিলো চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিত ড. আবদুল করিম এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম (গ্রামের বাড়ি মিরসরাই)। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন ড. সেলিম জাহাঙ্গীর। আমাকেও আমন্ত্রণ করেছিলেন আহমদ মমতাজ। গিয়েছিলামও। আমি দর্শক-শ্রোতার সারিতে বসা। ভুলেও ভাবিনি আমাকে কিছু বলতে হবে। বলার ক্ষেত্রে বরাবরই আমি কমজোর। মাইক হলে তো মুশকিল আরো বেশি। কমজোরির সাথে কাঁপুনিও এসে ভর করে। তাছাড়া মহান আল্লাহ বলার চেয়ে শোনার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। তাইতো তিনি বলার জন্য মানুষকে মুখ দিয়েছেন মাত্র একটি, আর শোনার জন্য কান দিয়েছেন একটি নয়, দু’টি। কিন্তু হঠাৎ ড. সেলিম জাহাঙ্গীর কিছু বলতে মাইকে আমার নাম ঘোষণা করলে, মান্যজনদের মুখ রক্ষার্থে আমিও অল্পকথায় আমার অনুভূতি ব্যাক্ত করেছিলাম। প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষে একটি বুকলেটও বেরিয়েছিলো, যাতে অন্য আরো অনেকের সাথে অধমের অভিমতও ছাপা হয়েছিলো।

চট্টগ্রামের ভাষা-সৈনিকদের নিয়েও কাজ করার আগ্রহ ছিলো তাঁর অন্তরে প্রবল। তখনো তা ছিলো পরিকল্পনা পর্যায়ে। একদিন সকালে সস্ত্রীক ট্রেন থেকে নেমেই আমাকে ফোন করে বলেন যে, কয়েকজন ভাষা সৈনিকের সাক্ষাৎকার নেবেন, আমাকেও তাঁর সাথে যেতে হবে। বিশেষ করে তমদ্দুন মজলিশের নেতা ও সন্দীপের সাবেক এমপি এ. কে. এম. রফিকউল্লাহ চৌধুরীর সাথে তাঁর পরিচয় নেই এবং উনার বাসাও চেনেননা বলে আমাকে যাওয়ার জন্য তাঁর জোর আবদার। আমি তাঁদেরকে সোজা আমার বাসায় চলে আসতে বলি। তাঁরা এলে একসাথে বসে সকালের নাস্তা সারি। তারপর বের হয়ে প্রথমে যাওয়া হয় আজাদী অফিসে। ঢুকতেই এক এক করে অরুণ দা, সিদ্দিক ভাই ও কাজী জাফরুল ইসলাম সাহেবের সাথে দেখা। প্রথম দু’জনের সাথে প্রাথমিক আলাপ সেরে সোজা গিয়ে বসি কাজী জাফরুল ইসলাম সাহেবের সামনে। বসেই টেপরেকর্ডারে সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু। আহমদ মমতাজ আগেই তা ফোনে জানিয়ে রেখেছিলেন। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে চলে সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ। তাতে কাজী জাফরুল ইসলামকে ভাষা আন্দোলনে তাঁর সংগ্রামী সম্পৃক্ততা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন আমিও করেছিলাম, যার জবাবও তিনি দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে সিঙ্গেল ও গ্রুপ ছবিও তোলা হয় আহমদ মমতাজের ক্যামেরায়। সেখান থেকে টেক্সিযোগে সোজা আসকার দিঘির পাড় – এ. কে. এম. রফিকউল্লাহ চৌধুরীর বাসায়। আমাকে আগে থেকেই চিনতেন চৌধুরী সাহেব। আমি তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই আহমদ মমতাজ দম্পতিকে এবং আগমনের হেতু ব্যাক্ত করি। তিনি হাসি মুখে আমাদেরকে গ্রহণ করেন এবং চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বসতে বলেন। তারপর শুরু হয় রফিকউল্লাহ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ। সাক্ষাৎকার নেয়া যখন শেষ হয়, তখন দুপুর গড়িয়ে আছর। শেষে ছবিও তোলা হয়। শুনেছি, পরে এ নিয়ে পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছেন। পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছেন কিনা তা জানিনা।

ভাষাসৈনিকের প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন চট্টগ্রামের আরেকজন ভাষাসৈনিকের কথা বলতে হয়। তাঁর নাম বদিউল আলম চৌধুরী। ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র ও তমদ্দুন মজলিশের তরুণ তুর্কি। ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আমার সম্পাদনায় ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী ‘বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন’ নামে যে সংকলনটি বেরিয়েছিলো, তার জন্য তিনি শুধু নিজে লেখা দিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি, প্রবীণ লেখক ও ভাষা সৈনিক আবদুল গফুরের একটি মূল্যবান স্মৃতিচারণমূলক লেখাও সংগ্রহ করে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছিলেন। মিরসরাই-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও তিনি মূল্যবান কাজ করেছেন। সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ও প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পত্র- পত্রিকায় লিখেছেন। আগামীতে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করবেন, সেগুলো তাদের জন্য উজ্জ্বল উপকরণ।

একদশক আগের কথা, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি চট্টগ্রামের সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের নিয়ে দু’দিনব্যাপী একটি সন্মেলনের আয়োজন করেছিলো। এতে অন্য অনেকের সাথে আমন্ত্রিত হয়ে আমিও ঢাকা গিয়েছিলাম এবং এর একটি অধিবেশনে কবিতা পড়েছিলাম।নিপু ভাই আর আমি একসাথে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিলো এবং আড্ডা হয়েছিলো। বিদায়ের দিন সমিতি ভবনের নিচে ড. শামসুল আলম সাঈদের সাথেও দেখা ও পরিচয় হয়েছিলো। শুনেছি, এই আয়োজনের পেছনে আহমদ মমতাজের অবদান ছিলো অধিক। চট্টগ্রাম সমিতির বার্ষিক যে সংকলনটি বের হয়, তাতে তিনি আমার একাধিক লেখা চেয়ে নিয়ে ছাপিয়েছেন। এর একটি লেখা ছিলো চট্টগ্রামের ‘শহর কুতুব’ খ্যাত মওলানা ওলী আহমদ নিযামপুরী (র)-এর ওপর, যিনি একাধারে ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলিম, অলিয়ে কামিল ও আরবি-ফারসি কবি। শুধু চট্টগ্রাম সমিতির বার্ষিকীতেই নয়, তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘চট্টগ্রাম পরিক্রমা’-য়ও তিনি আমার কাছ থেকে লেখা নিয়ে ছাপিয়েছেন। সর্বশেষ যে লেখাটি নিয়েছিলেন, সেটি ছিলো কাট্টলীর ভূমিপুত্র নূরুল হক চৌধুরীর ওপর, যিনি একাধারে ছিলেন প্রখ্যাত আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। পাক-পিরিয়ডে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন। একদিন টেলিফোন করে জানতে পারি যে, সর্বশেষ সংখ্যার সব লেখা কম্পোজও হয়ে গেছে। আর কয়েকটি লেখা পেলেই সংখ্যাটি প্রকাশ করে ফেলবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার আগেই করোনা তাঁকে নিয়ে গেলো আমাদের কাছ থেকে কেড়ে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ যখন টেলিফোনে তাঁর সাথে কথা হয়েছিলো, তিনি আমার সেই লেখার প্রবল প্রশংসা করে বলেছিলেন – যদি সংকলনটি প্রকাশিত হয়, তবে সেটিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক লেখা। তাঁর প্রশংসা শুনে, কেন জানিনা, বেশ লজ্জা লেগেছিলো সেদিন।

২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সন্মেলনের আয়োজন করেছিলো এএকাডেমি। অমর একুশে এই আয়োজন করা হয়েছিলো একাডেমি মিলনায়তনে। একদিকে বই মেলা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সন্মিলন। তখন একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান। শামসুজ্জামান খানের আমন্ত্রণে উক্ত সন্মেলনে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক ড. সালাউদ্দীন আইয়ুব। সালাউদ্দীন সম্পর্কে আমার সহধর্মিণীর ছোট ভাই। তার অনুরোধে আমি ও আমার স্ত্রীকে যেতে হয়েছিলো ঢাকায়। বাংলা একাডেমির সেই মিলন মেলায় সালাউদ্দীনকে সঙ্গ দিতে প্রতিদিনই যেতে হতো। গেলে আহমদ মমতাজের সাথেও দেখা হতো, কথা হতো। সেসব স্মৃতি কি কখনো ভোলা যায়!

চট্টগ্রামে এলে আহমদ মমতাজ আন্দরকিল্লায় কোনো হোটেলে কিংবা বন্ধুদের বাসায় উঠতেন। তবে হোটেলেই থাকতেন বেশি। ২০০৬ সালের ৫ মে এবং পরে আরো একবার তিনি আমার আমন্ত্রণে আমার বাসায় অতিথি হয়েছিলেন এবং রাত যাপন করেছিলেন। যে দুই রাত ছিলেন, গভীর রাত অবধি আড্ডার আনন্দে আন্দোলিত ছিলাম। আড্ডা ছিলো সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে। চট্টগ্রাম এলে কালধারা সভাপতি নিপু ভাইয়ের (শাহ আলম নিপু) অফিসে আসতেও ভুল করতেন না। হয় তিনি ফোন করতেন, নতুবা নিপু ভাই। গেলে সে কি আড্ডা! একবার তো নিপু ভাই, আহমদ মমতাজ, কবি আইউব সৈয়দ সহ রাত ৯ টা অবধি জম্পেস আড্ডা দিয়েছিলাম।

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংগঠন P.E.N Bangladesh শাখার চট্টগ্রাম থেকে যারা সদস্য , আমি ও আরিফ চৌধুরী হয়েছিলাম সবার আগে। পরে অন্যান্যরা সদস্য হয়েছিলেন। আহমদ মমতাজও হয়েছিলেন। P.E.N- এর এজিএম-এ প্রতিবছর ঢাকা গেলে সে উপলক্ষে তাঁর সাথে দেখা হতো, আড্ডা হতো। সে কি সুখময় স্মৃতি।
চট্টগ্রামে একটি ইতিহাস পরিষদ গঠন করা নিয়ে আমাদের অনেকের মতো তাঁরও ছিলো প্রবল আগ্রহ। ফোনে সেই আগ্রহ নিয়ে আলাপও হতো মাঝে মাঝে।

এ নিয়ে লেখক-গবেষক জামাল উদ্দীন-এর বলাকা প্রকাশনী কার্যালয়ে পর পর দু’টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আমি দু’টিতেই উপস্থিত ছিলাম। আহমদ মমতাজ ঢাকা থেকে এসে প্রথম বৈঠকে যোগ দিয়েছিলে। উক্ত বৈঠকে প্রখ্যাত গবেষক ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো, পুঁথি গবেষক ইসহাক চৌধুরী, ড. সেলিম জাহাঙ্গীর, ড. আবুল কাসেম, সম্প্রতি প্রয়াত লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু, কবি কমরুদ্দীন আহমদ, প্রাবন্ধিক তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী সহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে সবার সন্মতিতে সংগঠনের নাম স্থির হয়েছিলো ‘চট্টগ্রাম ইতিহাস পরিষদ’। পরিষদের পক্ষ থেকে একটি ত্রৈমাসিক গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছিলো, যার নাম ঠিক করা হয়েছিলো ‘চট্টল চিন্তা’। নামটি আমিই পেশ করেছিলাম, এবং সবার পছন্দ হওয়ায় সেটা গৃহীত হয়েছিলো।

আরেকটি স্মৃতির কথা এমুহূর্তে মনে পড়ছে। একবার চট্টগ্রাম এলে আমাকে নিয়ে তিনি বেরিয়েছিলেন কোথাও যাবেন বলে। কোথায় যাবেন আগে থেকে বলেননি। গিয়ে দেখি বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। বাসা বললে ভুল হবে, একেবারে সাদামাটা ভগ্নকুটির। ভেতরেও তাই। খাট, চেয়ার বলতে যে কয়েকটি আসবাব চোখে পড়লো, সেগুলোও বেশ পুরোনো এবং নড়বড়ে। আমাদের সাথে গিয়েছিলেন লেখক-গবেষক জামাল উদ্দীন ও আরো একজন। সেদিন আমরা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাটিয়েছিলাম বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর সান্নিধ্যে- আলাপে ও আন্তরিকতায়। সে কি সুন্দর স্মৃতি ! কিন্তু ‘যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরে পাওয়া যায়!’
তাঁকে নিয়ে কত কত স্মৃতি! সেই স্মৃতির সমাবর্তন থেকে সামান্য কয়েকটি তর্পণ করলাম মাত্র। বিদায়ের আগে তাঁকে নিয়ে লেখা একটি ক্লেরিহিউ (বায়োগ্রাফিকাল রাইম) উদ্ধৃত করে লেখার লাগাম টানতে চাই। প্রায় দেড় যুগ আগে লেখা ক্লেরিহিউটি এরকম-

লেখক-গবেষক আহমদ মমতাজ,
প্রত্ন-পৃথিবীতে পরিভ্রমণই তাঁর কাজ।
মেহেনতে তিনি মননকে করেন মূর্ত,
মৃতদের সাথে কথা বলে তাঁর কাটে মুহূর্ত।

লেখক- -মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, কবি ও গবেষক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.