হোটেলবয় থেকে ছগির রাতারাতি কোটিপতি
পরিশ্রম করে টাকা কামানোর চেয়ে জাল টাকা বানাতে পারলে রাতারাতি বড় লোক হওয়া অনেক সহজ- এটা ভাল করেই জানত ছগির হোসেন (৪৭)। তাই সে পথেই শুরু হয় তার যাত্রা। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় এসে কিছুদিন হোটেল বয়ের কাজ, তারপর ফেরিওয়ালার। তারপরই মিলে যায় জাল টাকা তৈরি চক্রের দেখা। তাতেই কপাল খুলে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই কোটিপতি বনে যায়। শেষ পর্যন্ত ধরাটাও খেয়ে যায়। তখনই বেরিয়ে আসে জাল টাকা তৈরির দুঃসাহসিক যাত্রার কাহিনী।
র্যাব সোমবার রাতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। তখন জানা যায়, ইদ্রিস নামক এক জাল টাকা কারবারির সঙ্গে সখ্যের পর জাল টাকা তৈরির কারবারে হাতেখড়ি ছগিরের। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির গ্রেফতারও হয়। এক বছর জেল খেটে পুনরায় সে জাল টাকা তৈরির কারবারে জড়ায়।
র্যাব জানায়, রাজধানীর মিরপুর এলাকার পল্লবীর একটি বাসা থেকে ছগিরসহ তিনজনকে আটক করা হয়। ওই চক্রের টার্গেট ছিল শীতকালীন বিভিন্ন মেলা, জন-সমাগম অনুষ্ঠান, বিশেষ করে পূর্বাচলে আয়োজিত বাণিজ্যমেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা তারা তৈরি করে। গ্রেফতারকালে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার জাল নোটসহ চক্রের অন্যতম হোতা ছগির হোসেন (৪৭) এবং তার সহযোগী মোছাঃ সেলিনা আক্তার পাখি (২০) ও রুহুল আমিনকে (৩৩) গ্রেফতার করে র্যাব-৪ এর একটি দল।
এ বিষয়ে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত ২৮ নবেম্বর র্যাব-৪ এর একটি দল মিরপুর মডেল থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ২৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার মূল্যমানের জাল নোটসহ জাল নোট তৈরি ও বিক্রয়কারী চক্রের সক্রিয় ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই চক্রটির হোতা ও অন্য সহযোগীদের সম্পর্কে জেনে র্যাব-৪ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৪ এর একটি দল ঢাকার পল্লবী এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি চক্রের হোতা ছগির হোসেনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। এ সময় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, ৫টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ১টি সিপিইউ, ১টি মনিটর, ৩টি প্রিন্টার, ১টি হ্যান্ড এয়ারড্রায়ারসহ জাল নোট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। তারা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এই জাল নোট তৈরি করে বিভিন্ন লোকের কাছে স্বল্প মূল্যে জাল নোট বিক্রি করে আসছিল। চক্রের সঙ্গে ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে।
জানা যায়, এই ছগির ঢাকায় এসে প্রথমে একটি হোটেলে বয়ের কাজ নেয়। তা ভাল না লাগায় কাজ নেয় ভ্যানে ফেরি করে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির। গার্মেন্টস পণ্য বিক্রয়ের সময়েই ছগিরের সঙ্গে ইদ্রিস নামক এক জাল টাকা কারবারির পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক ও জাল নোট তৈরির হাতেখড়ি হয়। ছগির প্রথমে জাল নোট বিক্রি ও পরবর্তীতে সে জাল নোট তৈরির বিষয় রপ্ত করে। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। বছর খানেক জেল খেটে পুনরায় সে ২০১৮ সাল হতে জাল নোট তৈরি শুরু করে। তৈরিকৃত জাল নোটগুলো তার চক্রে থাকা অন্য সহযোগী গ্রেফতারকৃত রুহুল আমিন, সেলিনা ও অন্য ৭/৮ জনের মাধ্যমে বিক্রয় করে আসছিল।
র্যাবের দেয়া তথ্যমতে ছগির জানিয়েছে, করোনার মধ্যে মাঝে মাঝে ছগির নিজেও এ জাল নোট স্থানীয় বাজারে ব্যবহার করত। সাধারণত কোন মেলায়, ঈদে পশুর হাটে ও অধিক জনসমাগম অনুষ্ঠানে তারা জাল নোট বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যবহার করত। সম্প্রতি পূর্বাচলে আয়োজিত বাণিজ্যমেলা ও শীতকালীন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব ও মেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা তারা তৈরির পরিকল্পনা করে ছগির। ২০১৭ সাল থেকে ১০ কোটি টাকা মূল্যমানের জাল টাকা তৈরি করেছে।
র্যাব জানিয়েছে, প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে ছগিরের খরচ হতো ৫/৬ হাজার টাকা। আর সে লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে। তার সহযোগীরা মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রি করত। টার্গেট বা চাহিদা অনুযায়ী ছগির প্রতি মাসে তার সহযোগীদেরকে বোনাসও দিত। হোতা ছগির নিজেই পুরান ঢাকা হতে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি ক্রয় করে। তার ভাড়া বাসায় গোপনে বিশেষ কৌশলে এ-৪ সাইজের দুটি টিস্যু পেপার একসঙ্গে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রঙিন প্রিন্টারে ডিজাইনকৃত টাকা তৈরি করত। সে নিজেই প্রিন্টিং ও কাটিং করত। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রিন্টিংয়ের কাজে অন্যদের সম্পৃক্ত করা হতো না। জাল নোট তৈরির পর সে তার অন্য সহযোগীদেরকে মোবাইলে কল করে তার কাছ থেকে জাল নোট নিয়ে যেতে বলত।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে আরও বেশ কজন চক্রের সদস্যের নাম জানা গেছে। তাছাড়া স্থানীয় বাজারে জাল টাকার উপকরণ বিক্রেতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ চক্রে জড়িত পলাতকদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খুব শীঘ্রই বাকিরাও ধরা পড়ে যাবে।
এ বিষয়ে র্যাব আরও জানিয়েছে, গ্রেফতার সেলিনা আক্তারের স্বামীও জাল নোট তৈরি চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য এবং বর্তমানে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে জেলে আছে। সেলিনা ঢাকা জেলার কামরাঙ্গীরচরে একটি বিউটি পার্লারের বিউটিশিয়ান। স্বামীর মাধ্যমে এ চক্রের হোতা ছগিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সে নিজেও এ চক্রে জড়িয়ে জাল নোট ব্যবসা শুরু করে। তার অন্য সহযোগীদেরও ধরার জন্য নজরদারি চলছে।