শিমু হত্যাকাণ্ডের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন শাখাওয়াত
অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমু ও তাঁর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম ১৬ জানুয়ারি যখন ঝগড়া করছিলেন তখন ওই বাসায় উপস্থিত ছিলেন এস এম ওয়াই আবদুল্লাহ ফরহাদ। ওই দিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টাকা চাইতে বন্ধু শাখাওয়াতের বাসায় যান ফরহাদ। তাঁর উপস্থিতিতেই ওই দম্পতির ঝগড়া শুরু হয়। বন্ধুর ডাকে একপর্যায়ে শিমুর গলা টিপে ধরেন ফরহাদ। এরপর শিমু মাটিতে পড়ে গেলে গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শাখাওয়াত। একপর্যায়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, শিমু মারা গেছেন।
গত ২০ জানুয়ারি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম সাইফুল ইসলামের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শিমুর স্বামী শাখাওয়াত। অপর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিশকাত শুকরানার কাছে জবানবন্দি দেন ফরহাদ। এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন দুজনই।
এই দুজনই স্বীকার করেছেন, হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে লাশ গুম করা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শাখাওয়াতকে সহযোগিতা করেন ফরহাদ। গ্রেপ্তার এড়াতে এ দুজন নানা ফন্দিও আঁটেন। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। এই মামলার তদন্ত করছে কেরানীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দীন কবিরের নেতৃত্বে একটি দল।
এদিকে গত শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ দক্ষিণ) হুমাযুন কবির কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলন করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন কবির ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ছালাম মিয়া এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। হুমাযুন কবির বলেন, টাকা চাইতে শাখাওয়াতের গ্রিনরোডের বাসায় যান। তাঁর উপস্থিতিতেই শাখাওয়াত ও রাইমা ঝগড়ায় জড়ান।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি উদ্ধৃত করে তদন্তে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জবানবন্দিতে শাখাওয়াত বলেছেন, ভালোবেসে তিনি শিমুকে বিয়ে করেন। দুই সন্তান নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। স্ত্রী তাঁর সম্মতি নিয়েই অভিনয়ে যুক্ত হয়েছিলেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলে চাকরি নিয়েছিলেন শিমু। ইদানীং স্ত্রীকে সন্দেহ করছিলেন। সে থেকেই মনোমালিন্যের শুরু।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাখাওয়াত বলেন, ১৬ জানুয়ারি সকালে ফরহাদ তাঁর গ্রিন রোডের বাসায় আসেন। শিমু দরজা খুলে দেন। ড্রয়িং রুমে ফরহাদকে বসতে বলে তাঁকে (শাখাওয়াত) ডেকে দেন শিমু।
শিমু এ সময় মুঠোফোনে কিছু একটা করছিলেন। শাখাওয়াত হঠাৎ বলেন, ‘তুমি (শিমু) আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতে, আমরা চা খাব কি না। জিজ্ঞেস না করে তুমি মোবাইলে কী করছ?’
একপর্যায়ে শিমুর হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেন শাখাওয়াত। এ থেকেই ঝগড়ার শুরু। কথা-কাটাকাটি থেকে একপর্যায়ে দুজনে ধস্তাধস্তি হয়। চিৎকার শুনে ফরহাদ তাঁদের শোয়ার ঘরে ঢোকেন। এ সময় শিমুর গলা চেপে ধরেন শাখাওয়াত। ফলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন শিমু। অকথ্য ভাষায় একে অন্যকে গালাগালি করতে থাকেন তাঁরা। এরপর শিমুর গলা টিপে ধরতে ফরহাদকে ডাকেন শাখাওয়াত। ফরহাদ শিমুর গলা টিপে ধরেন। ধ্বস্তাধ্বস্তিতে শিমু মাটিতে পড়ে যান। ফরহাদ আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, শিমু মাটিতে পড়ে গেলে শাখাওয়াত তাঁর গলার ওপর পা দিয়ে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর তাঁরা আঁচ করেন, শিমু মারা গেছেন।
এরপর শিমুর হাত ধরেন শাখাওয়াত। ফরহাদকেও হাতের নাড়ি ধরতে বলেন তিনি। নাকের নিচে হাত দিয়ে বুঝতে পারেন, শিমুর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ। এরপর থেকেই শুরু হয় লাশ লুকানোর চেষ্টা।
লাশ গুমের যত চেষ্টা
স্বীকারোক্তিতে শাখাওয়াত বলেছেন, মারা গেছেন নিশ্চিত হওয়ার পর শিমু লাশ চটের বস্তায় ভরেন তিনি ও ফরহাদ। শাখাওয়াত নিজেই একটি প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে বস্তা সেলাই করেন।
লাশ গুম করতে কী কী করেছেন তার বিস্তারিত আদালতকে বলেছেন এই দুই বন্ধু। ফরহাদের জবানবন্দি উদ্ধৃত করে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ পরই বাসায় গৃহকর্মী আসেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে শাখাওয়াত বলেন, ‘আপনি চলে যান। শিমু বাজারে গেছে। আধঘণ্টা পর আসেন।’
সিঁড়ি দিয়ে শিমুর লাশ ভর্তি বস্তা নামানোর সময় হঠাৎ এই দুই বন্ধু মনে হয়, সি সি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। সেটি বিচ্ছিন্ন করে আবার তাঁরা নামতে শুরু করেন। এ সময় ভবনের নিচে দায়িত্ব পালন করছিলেন দুজন নিরাপত্তারক্ষী। তাঁদের একজন জামাল। শাখাওয়াত তাঁকে ডেকে ইলেকট্রিশিয়ান খুঁজতে বলেন। আর অপর নিরাপত্তারক্ষী আরিফকে সিগারেট কিনতে পাঠান তিনি। কিছুক্ষণ পর জামাল ওপরে উঠে আসলে আরেক রক্ষী আরিফকে খুঁজে আনতে বলেন শাখাওয়াত।
কৌশলে দুজনকে সরিয়ে দিয়ে শিমুর মরদেহ গাড়িতে তোলেন দুই বন্ধু। ফরহাদ বলেন, এরপর শাখাওয়াত তাঁকে শিমুর মুঠোফোন নিয়ে গ্রিনরোডে মুঠোফোনের যে টাওয়ার তার সীমার বাইরে গিয়ে বন্ধ করে আসতে বলেন। যেন মনে হয়, শিমু বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। সেই কথা মতো ফরহাদ আজিমপুর গিয়ে মুঠোফোন বন্ধ করে আবারও গ্রিনরোডে আসেন।
লাশ গুম করতে প্রথমে দুই বন্ধু মিরপুরের দিকে যান। কিন্তু মিরপুরের নানা জায়গা ঘুরে কোথাও তাঁরা লাশটি ফেলতে পারেননি। দুপুরের পর বাসায় ফিরে আসেন, ঘরে না ঢুকে অপেক্ষা করতে থাকেন নিচেই। তখনো শিমুর মরদেহ গাড়িতে। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শাখাওয়াতকে তাঁর মেয়ে ফোন করে। সে জানায়, মায়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে শিমুর বোনও ফোন করেন। তিনিও জানান, শিমুর ফোন বন্ধ।
পরে ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়ে নির্জন জায়গা দেখে দুই বন্ধু শিমুর মরদেহ ফেলে দেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ফরহাদ বলেন, লাশ ফেলে ঢাকায় ফেরার পথে প্রথমে শিমুর ভ্যানিটি ব্যাগ ছুড়ে ফেলেন তাঁরা। আরও পরে মুঠোফোন পানিতে ফেলেন।
হত্যাকাণ্ডের সময় শিমু ও শাখাওয়াত দম্পতির ছেলে-মেয়ে বাসায় ঘুমিয়ে ছিল। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন কবির বলেন, রাইমার মেয়ে অনেক রাত অবধি পড়ালেখা করে ঘুমিয়েছিল। বাবা-মা ঝগড়া করলেও মাথা ঘামায়নি, ভেবেছিল আর সব দিনের মতো আবার মিটমাটও হয়ে যাবে। শিমুর ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন জানিয়েছেন, এই দুই সন্তান এখন তাঁদের খালার সঙ্গে আছে। আর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর আসামি দুজনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত।