২৭ বছর নির্জন গুহায় লুকিয়ে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অপরাজিত যোদ্ধা
১৯৪৪ সালে পালিয়ে যান গুয়াম দ্বীপে, দেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালে। ছবি: smithsonianmag
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের লজ্জা থেকে বাঁচতে প্রায় ২৭ বছর জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর সার্জন সোচি ইয়োকি। যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন গুয়াম দ্বীপে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পালিয়ে থাকা এই হার না মানা যোদ্ধা নিজ দেশে ফেরার পর বলেন, এটা আমার জন্য আরও বেশি লজ্জার (যুদ্ধ জয় না করে আমার জীবিত ফিরে আসা)।
মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মে গুয়ামের জঙ্গলে পালিয়ে যান সোচি ইয়োকি। তিনি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই দ্বীপে আত্মগোপনে ছিলেন। যখন তিনি ফিরে আসেন তখন তার বয়স ছিল ৫৬ বছর। ১৯৪৪ সালের আগস্টে আমেরিকান বাহিনী দ্বীপটি দখল করার পরে ইয়োকি প্রায় ২৭ বছর গুয়ামের জঙ্গলে লুকিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ রবার্ট রজার্সের মতে, ইয়োকি ওই ৫০০০ জাপানি সৈন্যের একজন যারা গুয়ামের যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল। যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হওয়ার লজ্জার চেয়ে জীবন বিসর্জন দেয়ার পথ বেছে নিয়েছিল। যদিও মিত্রবাহিনী কয়েক মাসের মধ্যে তাদের বেশিরভাগকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বা মেরে ফেলে। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ প্রায় ১৩০ জন জাপানি সৈন্য আত্মগোপনে চলে যায়। জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দুইজন স্থানীয় জেলে ইয়োকিকে ধরে ফেলেন। জাপান সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন এবং আত্মসম্মানবোধ ও সাহসের জাপানি দর্শন বুশিদোর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হার না মানা এই যোদ্ধা।
১৯৭২ সাল পর্যন্ত পালিয়ে থাকা এই হার না মানা যোদ্ধা নিজ দেশে ফেরার পর বলেন, এটা আমার জন্য আরও বেশি লজ্জার (যুদ্ধ জয় না করে আমার জীবিত ফিরে আসা)
সোচি ইয়োকির পলাতক জীবন
গুয়াম দ্বীপের শেষ যুদ্ধ; যেখানে ইয়োকির রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়ে যায়, ছবি: smithsonianmag
১৯৯৭ সালে ৮২ বছর বয়সে সোচি ইয়োকি মারা যাওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমসে নিকোলাস ডি. ক্রিস্টফ লিখেছিলেন, সম্রাটের প্রতি আনুগত্য ও গানবারু দর্শনের (নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা) উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন ইয়োকি। জাপানে ফিরে আসার পর তিনি ব্যাপক আত্ম-অনুসন্ধানে নামেন যে, তিনি কি সত্যিই তার জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে সময় ব্যয় করেছেন নাকি অযথাই?
১৯১৫ সালে জাপানের আইচি প্রিফেকচার শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইয়োকি। Wanpela.com অনুসারে, ১৯৪১ সালে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মিতে যোগ দেয়ার আগে একজন দর্জি হিসাবে কাজ করছিলেন তিনি। এই ওয়েবসাইটটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণ না করে পালিয়ে যাওয়া জাপানি সৈন্যদের একটি হিসেব রেখেছে। ইয়োকি ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে অবস্থান করেছিলেন। এরপর তাকে গুয়ামে পাঠানো হয়। ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মে আমেরিকান বাহিনী ইয়োকির রেজিমেন্টকে প্রায় ধ্বংস করার পর তিনি এবং নয়-দশজনের একটি দল জঙ্গলে পালিয়ে যায়। তারা যেন ধরা না পড়েন সেজন্য শুরু থেকেই নিজেদের পাঁয়ের ছাপ মুছে ফেলাসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। প্রাথমিকভাবে স্থানীয়দের গবাদি পশু খেয়ে বেঁচে ছিলেন পলাতক সৈন্যরা। কিন্তু যখন তাদের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকে এবং ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে, তখন তারা দ্বীপের আরও গভীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পশ্চাদপসরণ করেন। তারা বিভিন্ন গুহায় এবং মাটির নীচে গর্ত করে বসবাস শুরু করেন। নারকেল, পেঁপে, চিংড়ি, ব্যাঙ এবং ইঁদুর ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করতে শুরু করেন।
সার্জন সোচি ইয়োকি, ছবি:smithsonianmag
ওয়াশিংটন পোস্ট অনুসারে, ইয়োকি গাছের ছাল থেকে পোশাক বানাতে তার পোশাক সেলাইয়ের দক্ষতা কাজে লাগান এবং চাঁদ দেখে দিন/মাসের হিসাব রেখেছিলেন। অবশেষে একে একে তিনি তার সঙ্গীদের হারান। যাদের কেউ আত্মসমর্পণ করেছিল, কেউবা টহলরত সৈন্যদের শিকারে পরিণত হয়েছিল অথবা তাদের কঠিন জীবনধারার ফলে মারা গিয়েছিল। ১৯৬৪ সালের বন্যার আগ পর্যন্ত ইয়োকির সাথে দুইজন যোদ্ধার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালের বন্যায় তারা মারা গেলে শেষ আট বছর পুরোপুরি একাই এই দ্বীপে কাটিয়েছিলেন ইয়োকি। পঞ্চাশ বছর আগে, ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দুইজন স্থানীয় জেলে জেসুস এম ডুয়েনাস এবং ম্যানুয়েল ডি. গার্সিয়া নিকটবর্তী গ্রাম থেকে প্রায় চার মাইল দূরে তালোফোফো নদীর একটি অংশে ইয়োকিকে একটি বাঁশ দিয়ে তৈরি মাছের ফাঁদ পরীক্ষা করতে দেখেছিলেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) সেই সময়ে প্রতিবেদনে লিখেছিল, ইয়োকিকে শারীরিকভাবে দুর্বল অবস্থায় পেয়ে সহজেই তাকে পরাভূত করেছিল জেলেরা। (চিকিৎসকরা পরে জানিয়েছেন, তার কিছুটা রক্তস্বল্পতা থাকলেও তুলনামূলকভাবে তার স্বাস্থ্য ভালোই ছিল)।
দেশে ফেরার পর ইয়োকি
দেশে ফেরার পর ইয়োকি, ছবি: smithsonianmag
সোচি ইয়োকি ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে জাপানে ফিরে আসার পর কেঁদে ফেলেছিলেন। অনেক বছর পর প্রথমবার মানুষের মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি সত্যিই আতঙ্কিত হয়েছিলেন বলে বিবিসি নিউজ প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেছে। তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তাকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যাব – এটি একজন জাপানি সৈন্যের জন্য এবং দেশে ফিরে আসার পর তার পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা। ইয়োকির গল্প শোনার পর গুয়ামের কর্মকর্তারা তাকে জাপানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। যদিও তিনি দুই দশক আগেই যুদ্ধ বন্ধের লিফলেট এবং সংবাদপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে তিনি এই প্রতিবেদনগুলিকে আমেরিকান অপপ্রচার হিসাবে দেখেছিলেন এবং আত্মসমর্পণ থেকে দূরে থাকেন। ইয়োকি বলেছিলেন, আমাদের জাপানি সৈন্যদের বলা হয়েছিল যে জীবিত ধরা পড়ার অপমানের চেয়ে যেন মৃত্যুকে বেছে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দৈনিক ‘স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস’ পত্রিকায় ওয়াট ওলসন লিখেন, ইয়োকি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাড়িতে ফিরে আসার পর ৫০০০ মানুষ তাকে জাতীয় বীর হিসেবে স্বাগত জানায়। ফিরে আসার পর নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, সম্রাটের দেওয়া রাইফেলটি আমি ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু আমি দুঃখিত যে, আমি তাকে যথেষ্ট সেবা করতে পারিনি। এছাড়া ক্রিস্টফ লিখেছেন, ইয়োকি ফিরে আসার পর তার ব্যাপারে দেশে জনমত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, জাপানের বয়স্ক বাসিন্দারা তার ক্রিয়াকলাপকে অতীত যুগের অনুপ্রেরণামূলক আখ্যান হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং অল্পবয়সী লোকেরা তার আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করাকে অর্থহীন হিসেবে দেখছেন।
সার্জন সোচি ইয়োকি’র লুকিয়ে থাকা গুহা। ছবি: smithsonianmag
সোচি ইয়োকি ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এরপর ১৯৭৪ সালে সংসদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। পলাতক জীবনের অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তিনি একটি বই লিখেন যা সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৯৭ সালে তার মৃত্যুর আগে, তিনি বেশ কয়েকবার গুয়ামে ভ্রমণ করেছিলেন। ইয়োকি জাপানে ফিরে আসার দুই বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক হার না মানা যোদ্ধা লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোদা, ২৯ বছর লুকিয়ে থাকার পর ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে তার কমান্ডিং অফিসারের কাছে অস্ত্র সমপর্ণ করেন। ইয়োকির মতো হিরু ওনোদাকেও আত্মসমর্পণের পরিবর্তে মৃত্যুকে বেছে নেয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৪ সালের মার্চ পর্যন্ত দ্বীপ ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন, যতক্ষণ না তার কমান্ডিং অফিসার জাপান থেকে ফিলিপাইনে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন।