‘সেনা নিকেতনে’ ফেরা হলো না তাঁর

0 200

আর মাত্র বছরখানেক। তারপর সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। ফিরবেন গ্রামের বাড়ি। বাকি জীবন কাটাবেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

এ জন্য পটুয়াখালী পৌর শহরে বাড়িও করেন। নতুন ভবনের নাম দেন ‘সেনা নিকেতন’। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। চাকরি নয়, জীবন থেকেই ‘অবসরে’ চলে গেলেন তিনি। গত বুধবার রাতে বান্দরবানের রুমার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অভিযানের সময়  গোলাগুলিতে নিহত হন। তিনি সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার বথি ত্রিপুরাপাড়ায় ওই গোলাগুলিতে আহত হয়েছেন আরেক সেনা সদস্য। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মূল দলের সমর্থকদের সঙ্গে ওই গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। তাতে জেএসএসপন্থী তিন সন্ত্রাসীও নিহত হয়েছেন।

স্থানীয় পুলিশের সূত্র প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, নিহত তিনজনের কেউই বথি ত্রিপুরাপাড়ার বাসিন্দা নন। তাঁরা বিলাইছড়ি উপজেলার বাসিন্দা জয় চাকমা, বরকলের ঝিলিক চাকমা ও রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের নিয়াক্ষ্যংপাড়ার চমংপ্রু মারমা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষই এদের নাম পরিচয় জানায়নি।

গতকাল বৃহস্পতিবার আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জেএসএসপন্থী সন্ত্রাসীদের একটি দল রুমা উপজেলার বথিপাড়া এলাকায় চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে আসছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার রাইংখিয়াং লেক আর্মি ক্যাম্প থেকে সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবের নেতৃত্বে একটি নিরাপত্তা টহল দল ওই এলাকায় যায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে টহল দলটি বথিপাড়া এলাকায় পৌঁছলে একটি জুম ঘর থেকে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত টহল দলের ওপর গুলি চালায়। সেনা টহল দলটির দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা হামলায় জেএসএসের তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় পলায়নরত সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমানের মাথায় লাগে। ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। সৈনিক ফিরোজের ডান পায়ে গুলি লাগে। দুই সেনা সদস্যকে বৃহস্পতিবার সকালে হেলিকপ্টারযোগে রুমা থেকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তবে পিসিজেএসএস রুমায় সেনাবাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় সংগঠনের উপপ্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনসংহতি সমিতির কোনো সশস্ত্র শাখা বা ক্যাডার নেই।

আইএসপিআর জানায়, অভিযানে সেনা টহল দল সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত একটি এসএমজি, ২৭৫ রাউন্ড গুলি, তিনটি অ্যামোনিশন ম্যাগাজিন, তিনটি গাদা বন্দুক, গাদা বন্দুকের পাঁচ রাউন্ড গুলি, চার জোড়া ইউনিফর্ম এবং চাঁদাবাজির নগদ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা জব্দ করে। সেনা দল ওই এলাকায় টহল জোরদার করেছে।

বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার পাল বলেন, বথিপাড়া এলাকার ঘটনায় নিহত তিন সন্ত্রাসীর মরদেহ গতকাল সকালে রুমা থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য তিনটি মরদেহ বান্দরবান সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ, সেনা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার ত্রিদেশীয় ওই এলাকাটি গভীর জঙ্গলাকীর্ণ ও দুর্গম হওয়ায় দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসীরা সেখানে আস্তানা গেড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ক্যাডারদের সেখানে আনাগোনা বেড়েছে। এর আগে এই এলাকায় আরাকান আর্মি (এএ) ও আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) ক্যাডারদের শক্ত অবস্থান ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ ওই এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করে।

গত বুধবার রাতের ঘটনার পর আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

নিহত সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুরে। তবে পটুয়াখালী পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বহালগাছিয়া এলাকায় বাড়ি করেন তিনি। দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে তাঁর লাশ সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

‘ভুল করলে ক্ষমা করে দিয়ো, অভিযানে যাচ্ছি’

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে হাসিবুর রহমান তাঁর বাবার আর বছরখানেক পরে অবসরের কথা জানিয়ে বলেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জীবনের বাকি সময় কাটাতে তাঁর বাবা কয়েক বছর আগে পটুয়াখালী পৌর শহরের বহালগাছিয়া এলাকায় বাড়ি করেন। নতুন বাড়ির নাম ‘সেনা নিকেতন’। সেখানে বাবা ফিরেছেন, তবে দেশের জন্য লড়াই করে লাশ হয়ে।

গতকাল বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা যায়, মরদেহ দাফনের প্রস্তুতি চলছে। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকা। সেখানে ভিড় করেছে শোকাহত আত্মীয়, এলাকাবাসী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

হাসিবুর রহমান বলেন, ‘আব্বার সঙ্গে সব সময় কথা বলতে পারতাম না। তিনি যখন ফোন করতেন, তখনই কথা বলতে পারতাম। কারণ, নেটওয়ার্ক সমস্যা ছিল। গত রাতে (বুধবার) আব্বার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেছেন, কোনো ভুল করলে ক্ষমা করে দিয়ো, একটা অভিযানে যাচ্ছি। ’

গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় হাবিবুর রহমানের মরদেহ এলাকায় পৌঁছায়। এরপর যুবকের মাঠে জানাজা শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মরদেহ দাফন করা হয়।

সেনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। ছোট ছেলেও সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে কর্মরত।

২০১৯ সালেও নিহত হয় সেনা সদস্য

এর আগে রাঙামাটিতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে একজন সেনা সদস্য নিহত হন। ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট রাঙামাটি রিজিয়নের রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্প থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে পোয়াইতুমুখ এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত টহল দলের ওপর সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলি চালায়। এতে  সৈনিক নাসিম (১৯) গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। আহত সেনা সদস্যকে তত্ক্ষণাৎ হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

Leave A Reply

Your email address will not be published.