একটি ভাষণ অনন্য এক কবিতা

0 169

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তোমরা যারা এই লেখাটি পড়ছ তাদের অনেকেরই জন্ম হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশে। আর স্বাধীন দেশে বাস করে পরাধীনতার গ্লানি, পরাধীনতার কষ্ট, পরাধীনতার অপ্রাপ্তি, পরাধীনতার লজ্জার কথা কখনই অনুভব করা যায় না। এ কারণেই আজ আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না, আমাদের পূর্বপুরুষরা পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে কেন এত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, কেন জীবনপণ যুদ্ধ করেছেন, কেন এত রক্ত দিয়েছেন! আর তোমরা যারা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখোনি তারাও বুঝতে পারবে না, সে যুদ্ধে বাঙালি কতটা আত্মত্যাগ করেছে, কতটা আত্মবিসর্জন দিয়েছে।

আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু একাত্তরের ২৬ মার্চ হঠাৎ করেই কি এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল? নিশ্চয় না। এর পেছনেও ছিল অনেক কাহিনি, বাঙালির অনেক বঞ্চনা-অপ্রাপ্তি, অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম আর রক্তদানের ইতিহাস। সেই আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের একটি অংশ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ। ব্রিটিশদের পরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালি যখন স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদগ্রীব তখন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সে যুদ্ধে কী করতে হবে, কীভাবে পরাস্ত করতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীকে তার নির্দেশ দেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন নেতা। আগামীতে কী কী হবে, আন্দোলন কোন পর্যায়ে যাবে, পাকিস্তানিরা সে আন্দোলন দমন করার জন্য কী করতে পারে, তা অনেকটাই তিনি আন্দাজ করতে পারতেন। সে কারণেই তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীনতার জন্য বাঙালিকে যুদ্ধ করতেই হবে। আন্দোলন দমন করতে তাঁকে হত্যা অথবা বন্দি করা হতে পারে, এটাও তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আদেশ দেন। ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় দশ লাখ লোকের উপস্থিতিতে সেদিনের ভাষণের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে তার নির্দেশ দেন। ইঙ্গিত দেন গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকে পরাস্ত করতে।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’

বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানিরা তাঁর এ কথায় কান দেবে না। তারা বঙ্গবন্ধু বা বাঙালির দাবি মেনে নেবে না। এর বদলে তারা চাপিয়ে দেবে যুদ্ধ। তাই যুদ্ধ শুরু হলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে তিনি নির্দেশনা দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ সবশেষে তিনি এই বলে বক্তব্য শেষ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ভাষণের শেষদিকের এই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অংশটুকুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাকই দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন মাত্র ১৮ মিনিট বক্তৃতা করেছিলেন। এই ভাষণটি শুধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, অন্য বিশ্বনেতাদের দেওয়া ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশ্বের বড় বড় সব নেতা ও গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল্যায়ন করেছেন, প্রশংসা করেছেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’

যুগোসøাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’  গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

নিউজউইক পত্রিকা লিখেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা।’ টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।’ আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’

এসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলোকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে সংরক্ষণ করে থাকে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমন এই ভাষণ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, তেমনি পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন বিশ্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষিত থাকবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.