ইসলামে দণ্ড হিসেবে নামাজ আদায়

0 257

সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি আদালত গাঁজাসহ ধৃত দুই আসামিকে এক বছর কারাদণ্ডের পরিবর্তে পূর্ণ এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় এবং এতিমখানায় বাংলা অনুবাদসহ দুটি কোরআন প্রদানের নির্দেশ দেন। (দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট, ২০২২)

আইন ও বিচার অঙ্গনে এটি একটি ব্যতিক্রমী রায়। অপরাধীকে সংশোধনের লক্ষ্যে এটি প্রশংসনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ। এ প্রসঙ্গে কোরআনের এ বাণী খুবই প্রাসঙ্গিক যে ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখে।

(আল-কোরআন, ২৯ : ৪৫)

বাংলাদেশে বিরল হলেও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। যেমন—সংযুক্ত আরব আমিরাতে জেলখানায় বসে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করার পুরস্কার হিসেবে ২০০২-২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৯৫০ জন বন্দিকে ছয় মাস থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়।

(www.khaleejtimes.com/uae/2950- 10 Dec, 2017)  প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় সাধারণত এ ধরনের রায় দেখা যায় না। তবে ইসলামী আইন ও বিচার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের সিদ্ধান্তকে উৎসাহিত করা হয়। অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীর অনুশোচনা এবং আচরণিক পরিবর্তনের ফলে নির্ধারিত দণ্ড রহিত করার ঘটনা এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

একদা এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছি। আমার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করুন। তিনি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। (বর্ণনাকারী বলেন) এরই মধ্যে নামাজের সময় হলে সে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায় করে। নবীজি (সা.) নামাজ সমাপ্ত করলে লোকটি তাঁর কাছে গিয়ে বলল, হে আল্লার রাসুল (সা.), আমি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছি। আমার ওপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করুন। তিনি বলেন, তুমি কি আমাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করোনি? সে বলল, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৪৩৭)

এ হাদিসে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি অপরাধ করার পর তার মধ্যে অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং ইসলামের মৌলিক বিধান নামাজ আদায় করে এমনকি স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রদানপূর্বক নিজের ওপর দণ্ড প্রয়োগের আবেদন জানায়। এতে ইসলামী দণ্ডবিধির প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘শাস্তি দান নয়, সংশোধনই মুখ্য’ এটি অর্জিত হওয়ায় রাসুল (সা.) তাকে ক্ষমার ঘোষণা দেন।

এমনকি দণ্ডপ্রাপ্তকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইসলাম। সায়্যিদুনা আবু বাকর (রা.)-এর খিলাফতকালে এ ধরনের একটি ঘটনা হলো—আশআস ইবনু কায়স যখন মুরতাদ হিসেবে বন্দি হয়ে আসে এবং আন্তরিকভাবে তাওবা করে, তখন আবু বকর (রা.) শুধু তার প্রাণই রক্ষা করেননি; বরং তার আবেদন অনুযায়ী তাঁর (আবু বকর) বৈমাত্রেয় বোন উম্মু ফারওয়াহ (রা.)-কে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন। (ইবনু হাজর আসকালানি, আল-ইসাবাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৮)

কাদেসিয়ার যুদ্ধে মদ পান করার অপরাধে আবু মিহজান বন্দি অবস্থায় ছিলেন। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর দুরবস্থা দেখে তিনি সেনাপতি সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর স্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন যুদ্ধে শরিক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তিনি জীবিত থাকলে স্বেচ্ছায় বন্দি জীবন গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। অতঃপর তার বন্ধন খুলে দেওয়া হলে তিনি যুদ্ধে অসম সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করে শত্রুপক্ষকে তছনছ করে দেন। অচেনা এ যোদ্ধার বীরত্বে সেনাপতি সাদ নিজেও বিস্ময়াবিভূত হন। অবশেষে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ করলে সাদের স্ত্রী পুরো ঘটনা স্বামীর কাছে বর্ণনা করেন। বিস্তারিত জানার পর সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রা.) আবু মিহজানের শাস্তি মওকুফ করেন। শাস্তি মওকুফ করায় আবু মিহজান বলেন, আল্লাহর শপথ! আর কখনো আমি মদ পান করব না। (ইবনুল কাইয়্যিম, ইলামুল মুকিঈন, খণ্ড ৩, পৃণ্ড ৬-৭)

মদ পানের অপরাধে শাস্তি হবে জেনেও আবু মিহজান স্বেচ্ছায় কারাবরণ করায় সেনাপতি সাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে তার মধ্যে প্রত্যাশিত সংশোধন হয়েছে। সুতরাং তাকে আর শাস্তি দেননি। দণ্ড মওকুফের ফলও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে যে তিনি ভবিষ্যতে মদ পান না করার সংকল্পবদ্ধ হন।

তবে এ ধরনের দণ্ড মওকুফের বিধান সব সময়ের জন্য নয়; পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই একজন বিচারক সিদ্ধান্ত নেবেন। যেমন—মাদক সেবনের অভিযোগে অভিযুক্ত কুদামাহ ইবনু মাজউন প্রথম সারির মুহাজির, বদর ও উহুদের সঙ্গী—এ পরিচয় তুলে ধরে, দণ্ড থেকে রেহাই পেতে চাইলেও খলিফা উমর (রা.) মদ্যপানের দণ্ড কার্যকর করেন। (ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনি, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ২১)

অতএব বলা যায়, একজন অপরাধী যখন অনুতপ্ত হয়, তার আচরণে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসে এবং দণ্ড মওকুফ করলে ব্যক্তি বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না তখন একজন বিচারক শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের পথ তৈরি করে দিলে অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের পথ সুগম হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.