কোথায় যাবো, কী হবে, কী খাবো

0 282

অনলাইন ডেস্কঃ

ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। হতাশা-ভয়-আতঙ্ক আমাকে সচরাচর তাড়া করে না। সব পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও সর্বদা সন্তুষ্ট থাকার যে নীতিকথা আমি সারাটি জীবন অনুসরণ করেছি তা হাল আমলে এসে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রকৃতি-পরিবেশ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজ-পরিবার ও নিজের শরীর স্বাস্থ্যের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা প্রায় প্রতিদিন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রতিটি উপসর্গ ও অনুসর্গ পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়েছে। আহার-বিশ্রাম-নিদ্রা ও কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। আয়ের সাথে ব্যয়ের অমিল ও নিজের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যেভাবে ক্ষমতাধর মিথ্যুকদের দিয়ে হররোজ বলাৎকারের শিকার হচ্ছে তাতে করে আমার মনুষ্য জীবন ও বনবাদাড়ের অন্য প্রাণীদের জীবনের মৌলিক পার্থক্যগুলো ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে প্রায়ই পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কাঁচাবাজারের মুদির দোকানি, ফুটপাথের হকার, রিকশাওয়ালা, সরকারি কর্মচারী, সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-আমলা-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে যতই মতবিনিময় করি ততই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারো মুখে কোনো সান্ত্বনার বাণী অথবা সাম্প্রতিক সময়ে কারো চমকপ্রদ সফলতার কথা শুনতে পাই না। সবার মনে সীমাহীন বেদনা-অজানা আশঙ্কা। অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এখন প্রতিটি আদম সন্তানকে দেখলে মনে হয়- তারা জীবন্ত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ওপর বসে আছে।

কয়েক দিন আগে রিকশায় বাসায় ফিরছিলাম। মাত্র মাসখানেক আগে রিকশা ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। কিন্তু সেদিন যে ক’জন রিকশাওয়ালার সাথে দরাদরি করছিলাম তারা সবাই বললেন, ১২০ টাকার নিচে কেউ যাবেন না। রংপুর অঞ্চলের এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার রিকশায় বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক কথা হলো। বাড়তি ভাড়া সম্পর্কে তিনি জানালেন, জীবন আর চলছে না। বেশি ভাড়ার কারণে লোকজন রিকশায় ওঠে কম। ফলে দিন শেষে সাকুল্যে ভাড়ার যোগফল আগের মতো হয় না। অধিকন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় বাজার সদাই অনেক কম পরিমাণে কিনতে হচ্ছে। মাছ-গোশত-দুধের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেন না। ডাল-ভাত-আলু ও বড়জোর সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন একটু ডিমের তরকারি দিয়ে দুই বেলা আহার জোগানো সম্ভব নয়। আমি যখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম, দুই বেলা কেন, সবাই তো তিন বেলা খায়। আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা মুরব্বি এত করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে ঘাড় ফেরালেন যা দেখে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল।

রিকশাওয়ালার কথা বাদ দিয়ে আমার নিজের কথা খানিকটা বলে নিই। এই মহানগরীতে আমি প্রায় তিন দশক থেকে অর্থ-বিত্ত-বৈভবের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা করে বেঁচে আছি। তিন দশক আগে আমি চাকরি করতাম এবং মোটামুটি ভালো বেতন-ভাতার কারণে অভাব দেখিনি। আমার জন্ম একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে হওয়ার কারণে শৈশব ও কৈশোরেও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাবে বেদনাক্রান্ত হতে হয়নি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, সত্তর দশকের ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা, সার্বিক জাতীয় দারিদ্র্য, কেরোসিনের প্রদীপ, রেড়ি অর্থাৎ ভেন্নার তেলের সলতে, হারিকেন, মশাল ও উৎসবে হ্যাজাক লাইটের আলো দেখতে দেখতে জিয়া-এরশাদ জমানার বিদ্যুৎ এবং লোডশেডিংয়ের মধ্যে বড় হতে হতে আজকের পর্যায়ে কিভাবে যে পৌঁছে গেলাম তা ভাবতে গিয়ে মাঝে মধ্যে নস্টালজিয়ার মধ্যে পড়ে যাই।
আমার ছেলেবেলায় লোডশেডিং হলে কখনো খুশি হতাম আবার কখনো বেজার হতাম। কোনো নাটক চলাকালে বিদ্যুৎ গেলে টিভির সামনে বসে হাপিত্যেস করতাম। আবার শিক্ষক পড়াতে এসেছেন এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। বিশেষ করে বসন্ত-হেমন্ত-শরতের প্রথম প্রহরে বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকার আকাশের তারকা কিংবা জ্যোৎস্নার আলো মনের মধ্যে কবিত্ব নিয়ে আসত। কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিংয়ের কারণে অতীতকালের সেই ভাবাবেগ এই সময়ে কেন মরণ যন্ত্রণা হয়ে জীবনের সব সুখ কেড়ে নেয় তার সাতকাহন বুঝতে হলে আমার একদিনের কর্মযজ্ঞ বর্ণনা করা আবশ্যক।

দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত রাত সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে শয্যা ত্যাগ করি এবং অজু করে মসজিদে যাই। আগের দিনে স্বাভাবিক নিয়মে ঘুম ভাঙত; কিন্তু ইদানীং গভীর রাতে কয়েকবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে রাতে ঠিক কতটুকু ঘুমাই তা বলতে পারব না। ফলে ইবাদত-বন্দেগির যে স্বর্গীয় আনন্দ তা অবসন্ন-ক্লান্ত ও ঘুমহীন শরীরের যন্ত্রণার জন্য উপভোগ করতে পারি না। একই কারণে আমার আরো একটি অভ্যাস মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে আমি বছরের বেশির ভাগ সময় নফল রোজা রাখি এবং আমার এই অভ্যাসটি শরীর-মনের সাথে এত চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে যে, কোনো মাসে দুই-এক দিন যদি রোজা না রাখি ও নিয়মিত খাবার দাবার খাই তবে তা শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে সময়মতো সাহরি খাওয়া বা রোজা রাখা আর আগের মতো হচ্ছে না।

আমি সকাল সকাল কর্মস্থলে চলে আসি। এসেই দেখি বিদ্যুৎ নেই এবং দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে চার-পাঁচবার বিদ্যুতের লুকোচুরির কবলে পড়ি। আমার অফিসের সব এসি-লাইট, কম্পিউটার, ফ্যান ইত্যাদি সচল রাখার জন্য আজ থেকে ২৫ বছর আগে একটি বড় জেনারেটর কিনেছিলাম যা চালাতে প্রতি ঘণ্টায় ১৫ থেকে ১৭শ’ টাকার ডিজেল লাগে। আমার তিন যুগের ব্যবসায়িক জীবনে অফিস কিংবা শিল্পকারখানার জেনারেটরের তেল, গাড়ির তেল, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু গত চার-পাঁচ মাস ধরে আমি অফিসের জেনারেটর চালাতে সাহস পাই না। গাড়িতে বসে পেট্রোল খরচের চিন্তায় ঘামতে থাকি ও পেট্রোল পাম্পে গেলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি।

উল্লিখিত অবস্থায় আমার কর্মঘণ্টা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। আর কর্মপরিবেশ অনুকূল না থাকার দরুন সৃষ্টিশীলতা, নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা অথবা উদ্যম মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য, শরীর স্বাস্থ্য, আহার বিহার বিনোদন সব কিছু একেবারে লেজেগোবরে হয়ে পড়েছে। পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক সৌহার্দ্য ও স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ক্রমেই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে আমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোর সাথে পারিপার্শ্বিক সমস্যাগুলো যুক্ত হয়ে আমার বেদনার সাগরের বিস্তৃতি সীমাহীন করে তুলেছে অথবা অভাব ও অনিশ্চয়তার পাহাড় উঁচু হতে হতে ক্রমেই হিমালয়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।

আমার এক বন্ধু যিনি প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছেন এবং একজন সৎ সজ্জন ও সচ্ছল ব্যবসায়ী বলে যিনি সব মহলে প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি হঠাৎ করেই আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমরা একটি হোটেলে প্রায় চার ঘণ্টা সময় কাটালাম। ভদ্রলোকের ব্যবসায়-বাণিজ্যের দুরবস্থা শোনার পর মনটা ভারী হয়ে এলো। পাঁচতারকা হোটেলের বাহারি খাবারগুলো আমার কাছে বিষের মতো মনে হলো। আমি চার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হোটেলের বেশির ভাগ টেবিল খালি। উপস্থিত লোকজন ফিসফিস করে এমনভাবে কথা বলছে যা দেখে মনে হতে পারে, তারা কোনো কবরস্থানে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। রাজধানীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাঁচতারকা হোটেলটির কর্তাব্যক্তিরা এসে দেখা করে নিজেদের দুঃখের কথা বললেন এবং সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কোনো খাবারেই রুচি এলো না; বরং বিষণ্ণ মন নিয়ে সেখান থেকে বাসায় ফিরে দেখি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে আমাদের ধানমন্ডির বাড়ির সামনের রাস্তায় কোমর পানি আর বিদ্যুৎ নেই- ডিজেলের অভাবে জেনারেটরও চালু করা যাচ্ছে না।

উল্লিখিত বন্ধুর মতো আরো কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর সাথে সেদিন একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলো। তারা সবাই দেশের নামকরা বড় বড় কম্পোজিট টেক্সটাইলের মালিক। ঘটনার দিন ছিল আমাদের এক বন্ধুর মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। ঢাকা শেরাটনের গ্র্যান্ড বলরুমে বিশাল আয়োজন। খানাপিনা নাচ-গান কোনো কিছুরই কমতি নেই। কিন্তু আয়োজকসহ অভ্যাগত প্রধান অতিথিদের কারো মুখে হাসি নেই। খাবারে রুচি নেই। খানাপিনা বাদ দিয়ে সবাই বলাবলি করছেন, আজ কয় লাখ টাকার ডিজেল কিনেছেনÑ কত টন কাপড় রঙ করতে পারেননি এবং কত টাকা ব্যাংকের দেনা বেড়ে গেছে। তারা কথা প্রসঙ্গে নিজেদের শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি ও যেকোনো সময় মারা যাওয়ার শঙ্কার কথা বলে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিবেশ বিষাদময় করে দিলেন। উল্লিখিত অবস্থার সাথে দেশের রাজনীতি, উন্নয়নের অতীত গল্প ও বর্তমানের বেহাল দশা মনের ওপর মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। করের বোঝা, সরকারি অফিসগুলোর বাড়াবাড়ি, গরিব আত্মীয়স্বজনের হাহাকার ও ক্ষমতাধরদের মিথ্যাচারের কারণে মনে হচ্ছে আমি বা আমরা একটি কাচঘরে বন্দী আর বাইরে অসংখ্য বিষধর কালনাগিনী সেই কাচঘরের ভেতরে ঢোকার জন্য কিলবিল করছে। কাচঘরের মধ্যে অক্সিজেন নেই, খাবার নেই এবং মলত্যাগের ব্যবস্থা নেই। ফলে শ্বাসরুদ্ধকর দুর্গন্ধময় গুমোট পরিস্থিতিতে আমার কী হবে, আমার স্বাতন্ত্র্য কোথায় এবং আমি কী খাবো এই চিন্তা করার সামর্থ্য আমার মধ্যে আর কতক্ষণ অবশিষ্ট থাকবে তাও জানি না। ফলে জীবন্ত অবস্থায় মরণ চিন্তায় বিভোর হয়ে জ্ঞান হারানোর আগে একজন মানুষের শরীর মনের অভ্যন্তরে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চান তবে চলমান সময়ের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রকৃতি ও পরিবেশের চেয়ে উত্তম গবেষণা ক্ষেত্র দুনিয়ার অন্য কোথাও নেই।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.