মাজলুমের প্রতি ইসলামের নির্দেশ

0 165

অনলাইন ডেস্ক:

আজ পুরো পৃথিবীতে মুসলিমরা মাজলুম। মাজলুমদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেছে। এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে তারা নিরাপদ। তবে মাজলুমদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কারণ আল্লাহ তায়ালা জালিমকে ছাড় দেন, বিলম্বিত করেন তাঁর শাস্তি; কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেন না। জুলুম এমন একটি অপরাধ যার শাস্তি দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায়। তা ছাড়া পরকালের শাস্তি তো আছেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কারুন, ফেরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল; কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল, তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল’ (সূরা আনকাবুত : ৩৯-৪০)।

আল্লাহ তায়ালা জুলুমকারীকে সাথে সাথে পাকড়াও করেন না; বরং তিনি সুযোগ দেন। কুরআনের ঘোষণা- ‘তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল তবে তিনি ওদের সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যে দিন তাদের চক্ষু হবে স্থির। ভীত-বিহ্বলচিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে ওরা ছোটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি ওদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং ওদের অন্তর হবে উদাস’ (সূরা ইবরাহিম : ৪২-৪৩)। মাজলুম ব্যক্তি জালেমের জুলুম সম্পর্কে অন্যদের বলতে পারবে তার জুলুম থেকে অন্যদের বিরত রাখার জন্য কিংবা নিজে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য। কুরআনের বর্ণনা- ‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে ব্যতীত। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা নিসা-১৪৮)।

একজন মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে নির্যাতিত হতে দেখেও নির্লিপ্ততা অবলম্বন করবে- এটি কখনোই ভাবা যায় না। মুসলমান তো সেই জাতি, যারা একজন নারীর মর্যাদাহানি হতে দেখে কুফফারের বিরুদ্ধে নাঙা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই উম্মাহর সবচেয়ে জালিম হিসেবে খ্যাত হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো একজন ব্যক্তিও মাজলুম নারীর আর্তনাদকে উপেক্ষা করতে পারেনি। সর্বোচ্চ ঝুঁঁকি নিয়ে তিন তিনটি বাহিনী পাঠিয়ে রাজা দাহিরের বন্দিশালা থেকে মাজলুমদের মুক্ত করেছে এবং সিন্ধু পর্যন্ত ইসলামের শুভ্র নিশান উড়িয়েছে।

সব মুসলমান এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আক্রান্ত হলে গোটা দেহই তার সাথে ব্যথা ও বিনিদ্রায় শরিক থাকে। প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় নিজের জন্মদাত্রী মা ও অজানা অপরিচিত আরেকজন মুসলিম মায়ের মধ্যে পার্থক্য না করাই ইসলামের শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যে ব্যক্তি এমন স্থানে অপর মুসলিমের সাহায্য পরিত্যাগ করে, যেখানে তার সম্ভ্রম-মর্যাদা ক্ষুণœ হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা থেকে বিমুখ থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের সম্ভ্রম-মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার স্থানে তাকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য প্রত্যাশা করে (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮৪, মুসনাদে আহমাদ-১৬৩৬৮)।

একজন মুসলমান তার ভাইকে বিপদাক্রান্ত দেখে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কখনোই তার সাহায্য পরিত্যাগ করতে পারে না। হাদিসে এসেছে- তোমাদের কেউ যেন এমন জায়গায় অবস্থান না করে, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে জুলুমবশত হত্যা করা হয়। কারণ, যারা সেখানে উপস্থিত থেকেও তার প্রতিরোধ না করে, তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়। তোমাদের কেউ যেন এমন জায়গায় অবস্থান না করে, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে জুলুমবশত প্রহার করা হয়। কারণ, যারা সেখানে উপস্থিত থেকেও তার প্রতিরোধ না করে, তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয় (আল মুজামুল কাবির, তাবারানি-১১৬৭৫)।

মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে নিজে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না, (অন্য বর্ণনায় রয়েছে- তার সহযোগিতা পরিত্যাগ করবে না) (সহিহ মুসলিম-২৫৬৪, মুসনাদে আহমাদ-২০২৭৮)।

যে কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন (সহিহ বুখারি-২৪৪২)।
মুসলমানরা যদি আল্লাহর কোনো বান্দাকে মাজলুম হতে দেখেও জালিমকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সবাইকে আজাবে আক্রান্ত করবেন। মাজলুমের সহায়তা পরিত্যাগ করার দ্বারা তারা নিজেরাও জালিম বলে বিবেচিত হবে। হাদিসে এসেছে- মানুষ যদি কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচারে লিপ্ত দেখেও তার দু’-হাত চেপে ধরে তাকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা অতি শিগগিরই তাদের সবাইকে তার ব্যাপক শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত করবেন (সুনানে তিরমিজি-২১৬৮, সুনানে আবু দাউদ-৪৩৩৮)।

মাজলুমের করুণ আর্তনাদ ও ব্যথাতুর ফরিয়াদ বৃথা যায় না। মাজলুম জালিমের বিরুদ্ধে কোনো বদদোয়া করলে, আল্লাহ তা কবুল করে নেন। বুখারি শরিফের রেওয়ায়েত, হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মুআজ ইবনে জাবাল রা:-কে ইয়েমেনে (শাসক নিয়োগ করে পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ সা: তাকে বলেছিলেন, ‘মাজলুমের বদদোয়াকে ভয় করবে। কেননা, তার (বদদোয়া) এবং আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না’ (বুখারি-১৪৯৬)।

অপর হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না- ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, রোজাদার ব্যক্তি যতক্ষণ না সে ইফতার করে ও মাজলুমের দোয়া (এ শ্রেণীর মর্যাদা এই যে)। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তা মেঘমালার ওপর তুলে রাখবেন এবং তার জন্য আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে। আর আল্লাহ বলবেন, আমার ইজ্জতের কসম, একটু পরে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব’ (ইবনে মাজাহ-১৭৫২)।

তাই, আমাদের উচিত জুলুম থেকে আত্মরক্ষা করা। আর জালেমকে তার জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত রেখে সাহায্য করা। মাজলুমকে তার পাশে থেকে সব ধরনের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে সাহায্য করা। হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালেম হোক বা মাজলুম। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, মাজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করব? তিনি বলেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখবে’ (বুখারি-২৪৪৪)। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে মাজলুমের বদদোয়া থেকে হিফাজত করুন।

লেখক : ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Leave A Reply

Your email address will not be published.