তিস্তার আরও পানি নিতে পশ্চিমবঙ্গে দুটি খাল খননের উদ্যোগ
অনলাইন ডেস্ক:
তিস্তার পানি আরও সরিয়ে নিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করবে পশ্চিমবঙ্গ। এ জন্য নতুন করে দুটি খাল খনন করা হচ্ছে। ওই দুটি খালের মাধ্যমে তিস্তার পানি নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ। খাল খনন করতে পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগ এক হাজার একর জমি বুঝে পেয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
ভারতীয় এ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, পানি সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের আরও কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন প্রায় এক হাজার একর জমি সেচ অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেছে। এই জমি তিস্তার বাম তীরে দুটি খাল খননের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আরেকটি নদী জলঢাকা থেকে পানি সেচের জন্য খালের দিকে প্রবাহিত করা হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে বাংলাদেশে তিস্তার পানি প্রবাহ আরও কমে যাবে। তারা আরও মনে করেন, ভারত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, তিস্তা ও জলঢাকা থেকে পানি নেওয়ার জন্য কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে। তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি খাল খনন করা হবে। এর ফলে সেখানকার প্রায় এক লাখ কৃষক সেচের সুবিধা পাবেন।
জলপাইগুড়ি জেলার জল ডোবায় তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি ১৯৭৫ সালে ভারতের উত্তরাঞ্চলের ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চালু করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল তিস্তা থেকে নদীর দুই তীরের খালের মাধ্যমে পানি পাঠানোর। পথে খালগুলো সেই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদী থেকেও পানি পাবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে এখন ১ দশমিক ৪ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
গত শুক্রবার (৩ মার্চ) পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী বলেন, ‘জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন খাল খননের জন্য আমাদের কাছে এক হাজার একর জায়গা হস্তান্তর করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৯ সালে এটিকে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু, তহবিল সরবরাহ করেনি। তহবিল না পেলেও আমরা পর্যায়ক্রমে কাজ সম্পন্নের চেষ্টা করব।’
২০ বছরেরও বেশি সময় পর তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের অধীনে নতুন খাল খনন করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হবে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে নয়াদিল্লি ও ঢাকা তিস্তার পানি ভাগাভাগির জন্য চুক্তি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘এটা তাদের ৬০ বছর আগের পরিকল্পনা। সেটাই তারা বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে আমরা পানির অভাবে আরও মরব। তারা যত পানি তুলবে, আমাদের তত ক্ষতি হবে। এখন আমাদের কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কী উপায় আছে? আমাদের কী করার আছে? যা করার সরকারকে করতে হবে।’
ড. আইনুন নিশাত আরও বলেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুদেশের মধ্যে বর্তমানে যে দ্বন্দ্ব আছে তার মধ্যে ভারতের এই প্রকল্প অনেকটা আগুনে ঘি দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করবে। এখন কতগুলো প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, কোন সময় তারা পানি প্রত্যাহার করবে? শুকনো মৌসুমে তারা পুরো পানি প্রত্যাহার করলে সেই পানি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না, কারণ পানি তো শুকনো মৌসুমে নেই! দ্বিতীয় প্রশ্ন, তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ ও ভারতের যে দুটি ব্যারেজ প্রকল্প আছে, সেখানে পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তখন নদীতে কিছুটা পানি আসে, বাংলাদেশও কিছুটা পানি পায়। ভারত তার প্রকল্পের জন্য পুরো পানি প্রত্যাহার করার পরে তলানিটুকু বাংলাদেশ পায়। এখন সেই তলানি থেকে ভারত যদি আরও পানি প্রত্যাহার করে, তাহলে বাংলাদেশের আমন মৌসুমে মারাত্মক ক্ষতি হবে। রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, অর্থাৎ তিস্তা প্রকল্পের এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহানন্দা অববাহিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একজন শিক্ষক দ্য টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘এখন যখন সরকার সেচ নেটওয়ার্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, এটা স্পষ্ট যে তিস্তা থেকে আরও বেশি পানি নতুন খালের মাধ্যমে প্রবাহিত হবে। এর মানে হলো, শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য কম পানি পাওয়া যাবে।’
ভারতের পরিবেশবিদ ড. দীপায়ন দে ডয়েচে ভেলেকে বলেন, “যেকোনো নদীতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পানি ধরে রাখতে হয়, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘এনভায়রনমেন্টাল ফ্লো’। একাধিক বাঁধের কারণে তিস্তার পানি এমনিতেই তার নিচ দিয়ে বইছে। আবার দুটি খাল তৈরি হলে জলস্তর আরও নিচে নেমে যাবে। কারণ, তিস্তার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে ওই খাল কাটা হবে। এতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে এবং তিস্তার অবস্থা আরও খারাপ হবে।”
দীপায়ন আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত সিন্ধু নদীর পানি ভাগ করে নেয়। সেক্ষেত্রে ভারতের পলিসি একরকম। কিন্তু, তিস্তার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে ভারতের পলিসি ঠিক উল্টো। এর জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে কথা শুনতে হয়। নতুন দুটি খাল তৈরি হলে বাংলাদেশ আরও কম তিস্তার পানি পাবে। এতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের অবস্থান আরও খারাপ হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইমামুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভারত এটা করতে পারে না। ১৯৯৭ সালের ওয়াটার কোর্স কনভেনশন অনুযায়ী, আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি–তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভারতের। তবে, দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হলে আবার এই কনভেনশন কার্যকর হয়। কিন্তু, ২০১১ সাল থেকে আমাদের দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি নেই। কূটনৈতিক একটা আলোচনার মাধ্যমে এর একটা সমাধান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। নদীতে দুদেশের ঐতিহাসিক অধিকার আছে। কিন্তু, আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভারত একতরফা তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। তারা সব পানি টেনে নিয়ে যায়।’
ইমামুল হক আরও বলেন, ‘এই পানি পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও পাঠানো হচ্ছে। আমাদের এখন আরও জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। মমতা বলছেন–সিকিমে পানি আটকে দেওয়া হচ্ছে। সেটা তো সিকিম পারে না। কোথায় আটকে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের জানতে চাওয়া উচিত।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘এখন তিস্তা নিয়ে নতুন করে যা শোনা যাচ্ছে, এটা ভেরি আনফ্রেন্ডলি মুভ। এখন দেখার বিষয়–এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করছে, নাকি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার করছে। মমতার কারণে তো এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিস্তা চুক্তি আটকে আছে। আমাদের দিক থেকে বিষয়টি কীভাবে অ্যাড্রেস করা হবে, সেটা দেখার বিষয় আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা ভারতকে অনেক কিছু দিয়েছি। কিন্তু, আমার প্রশ্ন হলো আমরা কী পেয়েছি? বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তো গিভ অ্যান্ড টেকের ওপর হওয়া উচিত।’
শহীদুল হক বলেন, ‘তিস্তার মূল পরিকল্পনায় তো আমাদের এখানে জলাধার করার কথা ছিল। কিন্তু, সেটা তো হয়নি। এখন চীনের সহায়তায় করার কথা হচ্ছে। কিন্তু, অনেক দেরি হয়ে গেছে। যদি তারা তিস্তার পানি আরও তুলে নেয়, তাহলে রংপুরসহ উত্তরে ফসলি জমি তো উসর হয়ে যাবে।’
গ্রীষ্ম মৌসুমে তিস্তায় এখন ১০০ কিউসেক (কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ড) পানি পাওয়া যায় বলে বলা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা অস্বাভাবিক। উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণেই এমন হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশে কৃষিজমিতে সেচের জন্য প্রায় এক হাজার ৬০০ কিউসেক পানি প্রয়োজন। পানি সংকট নিরসনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।