মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সঙ্কট, সৌদি-ইরান মতবিরোধ তুঙ্গে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রিয়াদ: ইয়েমেনের সাথে ভূমি ছাড়াও আকাশ এবং সমুদ্র সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি আরব। শনিবার রিয়াদ লক্ষ্য করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা একটি দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, যা রিয়াদের বিমান বন্দরের কাছে ধ্বংস করা হয়। তারপরই সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট সীমান্ত বন্ধের এই সিদ্ধান্ত নিল।
সৌদি আরব বহু আগে থেকেই ইয়েমেনের উপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছিলো। কিন্তু এখন দেশটির সাথে আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। খবর বিবিসির।
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরকারি বাহিনীকে সহযোগিতা করছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক সামরিক জোট। কিন্তু এই যুদ্ধ সম্প্রতি আরো উত্তেজনা তৈরি করেছে, যখন হুতি বিদ্রোহীরা গত শনিবার সৌদি রাজধানী রিয়াদের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। সৌদি আরব বলছে, হুতি বিদ্রোহীদের কাছে এই ক্ষেপণাস্ত্রটি সরবরাহ করেছে ইরান।
তারা বলছে, এটা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইরানের যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। তেহরান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সৌদি আরবের অভিযোগ অযৌক্তিক এবং উস্কানিমূলক।
তিনি বলেন, এধরনের বানোয়াট অভিযোগের কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠছে।
সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
এর আগে শনিবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের শিয়াপন্থি হুতি বিদ্রোহীগোষ্ঠী। ক্ষেপণাস্ত্রটি রিয়াদের বাদশা খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশে প্রতিরোধ করে তা ধ্বংস করে সৌদি আরব। ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো টুকরো অংশ বিমানবন্দরে এসে পড়ে। তবে এতে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দেশটি দাবি করেছে।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি ও কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরা এখবর জানিয়েছে।
হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি টিভি চ্যালেন জানিয়েছে, শনিবার বাদশা খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোঁড়া হয়েছিল। হুতিদের একজন মুখপাত্র আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, স্কুড-ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বুরকান ২-এইচ ক্ষেপণাস্ত্র ইয়েমেন থেকে ছোঁড়ার পর সীমান্ত পার হয়ে ৮০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রিয়াদের আকাশে পৌঁছায়।
হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র সৌদি আরব আকাশেই ধ্বংস করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, বাদশা খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি এলাকা থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
দুর্নীতি দমন অভিযানে সৌদি আরবে রাজপুত্র, মন্ত্রীসহ বহু আটক
সৌদি আরবে নব গঠিত একটি দুর্নীতি দমন কমিটি দেশটির ১১জন রাজপুত্র, বর্তমান মন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে আটক করেছে। সৌদি ন্যাশনাল গার্ড এবং নৌবাহিনী প্রধানের পদেও করা হয়েছে রদবদল।
সৌদি যুবরাজ, মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রধান করে, শনিবার সৌদি বাদশাহ নিজে একটি দুর্নীতি দমন কমিটি গঠন করেন।
সদ্য গঠিত এই কমিটিই ১১জন রাজপুত্র, চারজন বর্তমান মন্ত্রী এবং প্রায় ডজন খানেক সাবেক মন্ত্রীকে আটক করেছে বলে জানা যাচ্ছে। আটককৃতদের নাম এবং তাদেরকে আটক করার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি। তবে, সৌদি গণমাধ্যম আল-অ্যারাবিয়া জানিয়েছে, ২০০৯ সালে সৌদিতে যে বন্যা হয়েছিল এবং ২০১২ সালে মার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা ঘটেছিল এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে।
নতুন এই কমিটি গঠন করার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটলো। সৌদি আরবের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, যুবরাজকে প্রধান করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে যুবরাজ চাইলে যে কাউকে গ্রেপ্তার করার এবং যে কারো উপরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
সৌদি ন্যাশনাল গার্ড এবং নৌবাহিনী প্রধানের পদেও রদবদল আনা হয়েছে। যুবরাজ সালমান ন্যাশনাল গার্ড মন্ত্রী প্রিন্স মিতেব বিন আব্দুল্লাহকে এবং নেভি কমান্ডার এডমিরাল আব্দুল্লাহ বিন সুলতান বিন মোহাম্মদ আল সুলতানকে বরখাস্ত করেছেন বলে জানিয়েছে এসপিএ।
তবে, তাদের কেন পদচ্যুত করা হয়েছে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।
কোন পথে সৌদি আরব?
এর আগে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার দেশকে আমূল বদলে দিতে চান। কিন্তু আবেগী এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ এই যুবরাজের সফলতার সম্ভাবনা কতটা, তা নিয়ে লিখেছেন জার্মান ভিত্তিক ডয়চে ভেলের নাদের আলসারাস।
‘নিওম’ – ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এমন এক শহর, যা হবে প্রযুক্তি গবেষণার প্রাণকেন্দ্র। পুরোপুরি সৌর শক্তিচালিত এ শহরে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যা থাকবে বেশি। প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বড় এই প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য খুঁজছেন স্বপ্নদ্রষ্টাদের, যারা নতুন কিছু করার কথা ভাবেন। ৩২ বছর বয়সি এ যুবরাজ এ সময়ের সৌদি আরবের অন্যতম ক্ষমতাবান মানুষ, নিওমের মতো চমকপ্রদ কিছু করার কথাই কেবল যিনি ভাবছেন না, যিনি তার দেশে ফিরিয়ে আনতে চান উদার ইসলামের চর্চা।
সৌদি আরবের মতো একটি দেশ, যা দীর্ঘদিন ধরে সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে, দুই শতক ধরে যে দেশে ওহাবিজমের মতো কট্টর ইসলামি ধ্যানধারণা প্রচলিত, সেখানে এমন পরিবর্তনের সুর বিষ্ময়কর।
কিছুদিন আগেই নারীরা গাড়ি চালানোর অধিকার পেয়েছেন। রেড সি’তে পর্যটকদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে, যার অর্থ নারীরা সেখানে বিকিনি পরতে পারবেন, উন্মুক্ত থাকবে বার। পরিবর্তনের এমন সুর কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়।
অবশ্য সৌদি যুবরাজের এই উদারপন্থি মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করছেন অনেকে। একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হটানোর কৌশল ভাবছেন অনেকেই। অনেকেই আবার বলছেন, এটা দেশে বিনিয়োগের আকর্ষণের কৌশল।অবশ্য অনেক সমালোচনা ভিত্তিহীনও নয়। এর মধ্যে সরকারের সমালোচনাকারী অনেক নেতা আটক হয়েছেন।
রাজ্যের সত্যিকারের প্রয়োজন, যেমন গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা নেই কোনো। অন্যদিকে, সৌদি যুবরাজের উদারপন্থি এই মনোভাবের কারণে কট্টরপন্থী ও রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারে রাজপরিবার।
এছাড়াও, এক ধাক্কায় দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের ভাবনাও খুব উচ্চাকাঙ্খী, বিশেষ করে উদার রাজ্য গড়তে সৌদি যুবরাজের প্রচেষ্টা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ মানুষও। এর মধ্যে বিন সালমানকে এতটা ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে। ২০১৫ সালের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েই ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরির পর তাকে দেয়া ক্ষমতার কতটা সদ্বব্যবহার তিনি করবেন, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
দেশকে আধুনিক করা কেবল কয়েকটা বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার উপর নির্ভর করে না। এর জন্য প্রয়োজন আরো বেশি কিছু। খুব অল্প সময়ে তা হবার নয়। এর সাথে যোগ হয়েছে তেলের রপ্তানিমূল্য কমে যাওয়া এবং সৌদি বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। সবমিলিয়ে, সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের পরিকল্পনা কতটা কাজ করবে , তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।