এবারের রোজায় তুলনামূলক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খাদ্য পণ্য
অনলাইন ডেস্ক:
রোজার মাসে ইফতারে শরবত, জিলেপি ও অন্য খাবার তৈরিতে চিনির প্রয়োজন। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, সাধারণত দেশে প্রতি মাসে গড়ে দেড় লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে লাগে তিন লাখ টন। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার অনেকটা বাড়তি ব্যয় করতে হবে সাধারণ মানুষকে।
গত বছর দেশে পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দিন প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। এবারের রোজার ঠিক আগে সেই চিনি প্রতি কেজিতে ৩৭ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও এবারের রোজায় আটা, ময়দা, ছোলা, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, মাছ, মাংস ও ডিম কিনতেও ব্যয় বাড়বে। গত এক সপ্তাহে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও বাজার আগে থেকেই চড়া।
বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) দিবাগত রাতে সাহ্রি খাওয়ার পর শুক্রবার (২৪ মার্চ) থেকে রোজা শুরু হবে। বাজারে ইতিমধ্যে রোজার কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে থাকায় কেনাবেচা খুব বেশি নয়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মুদিদোকানদার আবুল কাশেম বলেন, একদিন পরেই রমজান অথচ তেমন বাড়তি বেচাকেনা নেই।
গত রমজানের তুলনায় সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের চাহিদা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম থাকবে বলে গত ১৯ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় আলোচনা হয়।
২০২২ সালের ৩ এপ্রিল শুরু হয় রোজা।ওই দিন বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা ও বুধবারের(২২মার্চ) তালিকা ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল, মসুর ডাল, আলু ও পেঁয়াজের দামে তেমন পার্থক্য না হলেও বেশির ভাগ পণ্যের দাম চড়া।
নিম্নবিত্তের প্রাণিজ আমিষের উৎস ব্রয়লার মুরগি এখন তাদের নাগালের বাইরে। টিসিবির হিসাবে ব্রয়লার মুরগির কেজিপ্রতি দর উঠেছে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকায়, যা গত বছরের রমজানের চেয়ে ৫১ শতাংশ বেশি। বুধবার (২২ মার্চ) ঢাকার কারওয়ান বাজার, মালিবাগ বাজার ও সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা দরে।
এছাড়াও ফার্মের মুরগির এক হালি ডিম কিনতে হবে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকায় যা গত বছরের রমজান মাসের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি।
চাষের কই, পাঙাশ, তেলাপিয়া এই তিন মাছের দর সাধারণত স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু গত এক বছরে দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ছোট পাঙাশ মাছ ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় ১ কেজি পাওয়া যেত। সেটা এখন ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বুধবার (২২ মার্চ) রাজধানীর মালিবাগ ও সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি ওজনের পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মাঝারি আকারের তেলাপিয়া।
এই রমজানে প্রতি কেজি খোলা আটা কিনতে হবে সর্বনিম্ন ৫৫ টাকায়। গত বছর সর্বনিম্ন ৩৪ টাকা ছিলো আটার কেজি। প্যাকেটজাত আটা ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা ৪০-৪৫ টাকা ছিলো গত রোজায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোজ্যতেল, চিনি, গম, মসুর ডাল ও ছোলার সরবরাহ আমদানিনির্ভর। এসব পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে। আবার মার্কিন ডলারের দাম বাড়ায় আমদানির খরচ বেড়েছে। এছাড়া গত বছর রোজার আগে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা এখন ১০৫ টাকার বেশি। ডলারের দামের কারণে গবাদিপশু, মুরগি ও মাছের খাবারের দাম বাড়ায় তাদের উৎপাদন খরচও বেড়েছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করেতে হচ্ছে।
গত ১৯ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ খামারের আকারভেদে প্রতি কেজিতে ১৩৫ থেকে ১৬০ টাকা। এটা সর্বোচ্চ ২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া উচিত। কিন্তু বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াকেও মূল্যবৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দফায় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। শুধু জানুয়ারিতেই গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম।
নিত্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার তাসলিম গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববাজার এখন বড় বিষয় নয়, সমস্যা হলো ডলারের দাম, পরিবহন খরচ ও গ্যাস–বিদ্যুতের দাম। তিনি বলেন, আমদানির পরে ঋণপত্রের দায় পরিশোধ করা হয় অন্তত ছয় মাস পর। তখন ডলারের দাম কী দাঁড়াবে কেউ জানে না। এই অনিশ্চয়তা আমদানির ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা বলেও মনে করেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার দরিদ্র মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে একটি জরিপ চালায়। দেশের উত্তর ও হাওরাঞ্চলের ৮টি জেলায় চালানো জরিপে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না ৮২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন নিম্নবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষ খুব চাপে আছেন। বাজারের এই অবস্থার জন্য বিশ্ববাজারকে নতুন করে দায়ী করার কিছু নেই। তদারকি ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও রয়েছে। সাময়িক সময়ের জন্য ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও গরুর মাংস আমদানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।