মোসলেহ্ মহসিন
নব্বই দশকের অন্যতম কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদ মূলত প্রেমের কবি। তবে তার কবিতা বরাবরই ভিন্নতর। তার প্রথম কাব্য ‘সেপ্টেম্বরের ইলশে রোদ ঘিয়ে বিষ্টি’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে, চট্টগ্রামের পোয়েটিক্স থেকে। ৪৮ পৃষ্ঠার এ কাব্যে ১০টি গজল, ৫টি দোঁহা, এবং ৪০ টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ কাব্য প্রকাশের পর দীর্ঘ একযুগের বিরতি দিয়ে ২০১৭ তে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিখিলেশ কেমন আছো’। চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘গলুই’ থেকে বের হওয়া এ কাব্যটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও প্রতিটি কবিতায় প্রাসঙ্গিক অলংকরণ করেছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। প্রায় ৭৯টি ছোট বড় দীর্ঘ ও অনুবাদ কবিতার গ্রন্থনা এটি। প্রতিটি কবিতার বিষয় প্রাসঙ্গিক ইল্যাস্টেশন কাব্যটির বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গজল নিয়ে একপৃষ্ঠা চমৎকার ভূমিকাসহ গজল সম্রাট আসাদুল্লাহ খা গালিবের পাঁচটি গজল অনুবাদ, উপমহাদেশে অন্যতম উর্দু কবি আলতাফ হোসেন হালি’র তিনটি রুবাইয়াত অনুবাদ, মধ্যপ্রাচ্যের খ্যাতিমান সূফী কবি মনসুর হাল্লাজ এর পাঁচটি কবিতা অনুবাদ পাঠরুচিতে বৈচিত্র্য এনেদেয় ‘নিখিলেশ কেমন আছো’ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া টুকরো কবিতা শিরোনামে ৬টি কবিতা, চৌপদী শিরোনামে ৯টি চুম্বকীয় কবিতামালা পাঠক হৃদয় আদ্র করার মতো। এছাড়া এ কবির নিজস্ব ঘরানার ৩৪ টি কবিতাতো রয়েছেই। সাথে তার পরিমিত শিল্পবোধ ও সৃষ্টিশীল পংক্তিমালা কবিতা পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। কবি ও প্রাবন্ধিক মাঈন উদ্দিন জাহেদ এর কবিতার বই “নিখিলেশ কেমন আছো” বাংলা সাহিত্যে একটা অন্যরকম জায়গা করে নেয়ার মতো।
কবি জাহেদ এর কবিতায় কাব্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকারিত্ব, উপস্থাপনার নতুনত্ব তাকে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছে। নব্বই দশকে যে কজন তরুণ কবিতায় উত্তারাধুনিক মনোচৈতন্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও কাব্যশৈলীকে গ্রাহ্য করে কবিতায় বুনে ছিলেন নিজস্ব শব্দরাশি জাহেদ তাদের মাঝে অন্যতম।
চিরায়ত প্রেম জাহেদ আঁকেন তার একান্ত নিজস্ব ভাষায়-
‘‘ভালবাসি চারপাশের ছাদের কার্ণিশেরে।
ঝুলে আছে অগোছালো কিছু সন্ধ্যামালতি-
আমাদের চারপাশে সুনসান ছাদ আছে
এবঙ আমাদের? আমাদের চাঁদ আছে।’’
[আমাদের চারপাশে সুনসান ছাদ আছে]
মাঈন উদ্দিন জাহেদের পংক্তি বেশ সুন্দর, বুলবুল সরওয়ারও অপকটে স্বীকার করেছেন। যেমন-
‘‘সাত তলা দালানের রমণী পায় কী মাটির গন্ধ?
রিমঝিম বিষ্টির শব্দ, রিমঝিম দুপুরের ছন্দ?’’
[সাততলা-একতলা গপ্প]
রোমান্টিকতা আর দ্রোহের মধ্য দিয়েও জাহেদের কবিতায় মাটির গান গায়-
‘‘চাষার বসন্ত যায় আক্রান্ত খরায়-
কর্ষণের ইচ্ছা বাড়ে রকত ও গতরে;
ভরটনাট্যমে বুদ হয়ে আছে পৌঢ় স্বজন
চাষাদের বাঙলা যখন চমৎকার খরায়।’’
[মাটির গান কিংবা চাষার কারাস]
জাহেদের কবিতার অন্যতম দিক হচ্ছে নজরকাড়া ছন্দ-
‘‘ফাগুনের হই হই
শিমুলের কই;
যুবকেরা যুদ্ধে
প্লাশেরা কই;
ফাগুনের হই হই…
আগুনের হই।’’
[হই]
সযত্নে উপমার ব্যবহার জাহিদের কবিতার আরেক বিশেষত্ব-
‘‘রোদ্গুলো গুছানো মেঘের মতো কিশোরীর ফ্রকে খেলা করে,
শুধু পাখা ঝাপটায় চৈতন্য জুড়ে শাদা শাদা বক;
মিঠেলা রোড আর ঝিলের জলে স্নান সারে সেপ্টেম্বর।’’
[সেপ্টেম্বর মানে বাউল হয়ে যাওয়া]
তবে জাহেদের উপমার মধ্যেও দ্রোহ রয়েছে-
‘‘রক্তের মাঝে কিভাবে নাচছে সুলতানের ব্রাশ।’’
[সুলতানের ব্রাশ]
সূফি ঘরানার রহস্যময় ফানা সিরিজ নিয়ে কবি বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। ইতিমধ্যে তিনটি ফানা সিরিজ শেষ ক্রেছেন। আরও সতেরটি বাকী রয়েছে। ফানা সিরিজের কবিতা যেমন-
‘‘হায়! এ কেমন বেদনাময়? পারি না ছুঁতে’’
[ফানাগুচ্ছ-১]
কিংবা
তোমাকে ধারণ করেছি ঠোঁটে
তোমাকে ধারণ করেছি বুকে
তোমাকে ধারণ করেছি হৃদয়ে
তোমাকে ধারণ করেছি সত্তায়;
আর কতটুকু ধারণ করলে
তুমি, আমি হবে?”
[ফানাগুচ্ছ-৪]
কবিতায় জাহেদ যথারিতি পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত, আর বাক্য ও শৈল্পিক কারুকাজে পারদর্শী। স্মৃতিকাতরতা, ভালোবাসা, ক্ষোভ, দেশচিন্তার পাশাপাশি কবি সময়কে ধারন করেছেন নানা ভাবে। প্রত্যেকটি কবিতায় অনিন্দ সুন্দর শিল্পিত ভঙ্গিমায় জাহেদ শব্দ যোজনা দিয়েছে নিজস্ব ঢঙে: কিছু নমুনা …
১. “হায় বাসনা! তুমি কি জোড়া কমালালেবু? কামনার ছোট বোন?
তোমাকে গোপন করে দিন দিন আমরা ভব্য হয়ে উঠি! [হায় বাসনা ]
২. “ঝিঁঝিপোকারা আমাকে চেনে
চেনে মেয়ে মৌমাছি আর কাঠপোকা;
ওদের চিৎকারে ধ্যান ভাঙ্গে
ভেবাচেকা টিকটিকির সঙ্গমে।
[ রাতের আলপনা ]
৩. “মিলিটারি গেলো, বাংলার মসনদে বাঙালিই রাজা,
আমরা তো প্রজা হয়েই আছি;
তনুরা এখনও নিখোঁজ হয় মিলিটারির হাতে,
পুলিশের হাতে হারিয়ে যায় কত শত বাঙাল,
আমরা এখনও কাঙাল;
মুক্তিকামী রুমিরা এখনও পথ খোঁজে মানবমুক্তির।”
[ ডিসেম্বরের গল্প]
৪.”কোথায় অরণ্য? অরণ্য ঢুকেছে এখন মানুষের বিবরে;
এই বুনো পৃথিবীতে
চাইবার নেই এ্যাইটুকু ঠাঁই!
রক্তাক্ত ফিলিস্তিন, আফগান, ইরাক, সিরিয়া, আরাকান
যেদিকে তাকাই
শুধু ক্লান্ত হই, ক্লান্ত হই, দুচোখ ফিরালেই দেখি
কোথাও মানুষ নাই……”
[অরণ্য ঢুকেছে মানুষের বিবরে]
৫.”রাতগুলো যুবতী হলে আমাদের সুখদ পুরুষ পৃথিবী নিদ্রাহীনতায় ভোগে;
বালখিল্যের সন্ধ্যা গড়িয়ে গড়িয়ে রাঙা মেঘকে ডাকে চুম্বনের তৃষায়;”
[হিসেব]
৬. “যে আমাকে ভালোবেসে সমস্ত দিয়েছে ঢেলে
তারে আমি ভাড়ায়েছি আলস্যের কৌশলে।” [দোহাগুচ্ছ-২]
৭. “মৃত্যু আমাকে নিয়ে যায় ঘুমে অনেক রাত্রি শেষে;
মৃত্যু অধিক জিঘাংসার ক্ষুধা, একটু একটু এসে;
আমাকে লোভাতুর করে ভাসাতে ভাসাতে,
মৃত্যুর অধিক দাম্ভিক হতে উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে। [ মৃত্যু]
৮. আমি নি:শেষ হবো তবু তাদের ছুঁড়ে দেয়া বল্লম
পুঁতে দেবো নাক্ষত্রিক আকাশে;
ওরা সীমার হলে আমিতো হোসাইন-
[কারবালা]
৯. জীবন ঘষে জেনেছি
একা থাকা হারাম;
পিঠ চায় সঙ্গ সুখ
বুক চায় আরাম।
[চৌপদী : ৫]
কবি নিজেকে চেনান তার নিজস্ব কাব্য ঢং এ-
আমি রৌদ্র দাবানো ছেলে –
এ শহরের বাদামি কাক;
শৈশব থেকে সাইনাস
শৈশব থেকে সানগ্লাস।
[চৌপদী: ৪]
জাহেদের মনন বুদ্ধিবৃত্তিক পলিতে গড়া সেটা তার কবিতা পড়লেই বুঝা যায়। যেমন-
“কতদিন সরদার ফজলুল করিমের ক্লাস করার মজা-ই পাই না-
নিজেকে সক্রেটিস কিংবা প্লেটো ভাববার বোধ
কজন তৈরি করে দিতে পারে?”
[নিখিলেশ কেমন আছো]
জাহেদ সময়টাকে চিত্রিত করেছেন বাঙময়ে-
“…আর কতো সামলাবো? এটা তুলতে ওটা পড়ে।
তুলতে তুলতে কাপড়টা লজ্জাকে অতিক্রম করেছে,
বড় বেশি বেহায়া হই- বাড়ে ক্রোধ- উথ্থিত পৌরষ।”
[এক বর্ষার গল্প]
আবার বর্তমান তারুনয়ের উচ্ছন্নে যাওয়া দেখে কবি সংকিত। তবে কবি জানেন মানুষ একদিন ফিরবেই-
‘‘বায়োস্কোপ দেখে দেখে তরুণেরা শিশ্ন শানায়।
তারারা মরে গেলে উল্কাগুলো ছোটে আসমানে-
শয়তান খবর ছড়ায় মিডিয়া প্রোপাগান্ডায়;
…………………
তারারা মিছিলে যাবে- উল্কা কিংবা সূর্য হবে সময়ের-
রচে যাবে তারা চরম মনোরম উদ্যান শুধু মানুষের।’’
মাঈন উদ্দিন জাহেদ তার কবিতায় জীবনের নানা রঙ ধরার চেষ্টা করেছেন –
“শিমূলেরা গান গায় কার্তিক সন্ধ্যায়,
সেপ্টেম্বর ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়;
গীন্সবার্গ হেঁটে হেঁটে স্বপ্নের ভিড়ে-
পায়ে পায়ে ছড়ায় জীবন;
জীবনের নানা রঙ; রঙ বেরঙ মন।’’
[সেপ্টেম্বর ছুঁয়েছে যাকে]
কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদ কবিতার পাশাপাশি নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় বেশ সিদ্ধহস্ত। স্বনামধন্য নানা পত্রিকা, সংকলন, লিটলম্যাগ এবং জার্নালে প্রচুর নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন সম্পাদিত বাংলাএকাডেমি বাংলা সাহিত্য কোষে ১১টি আলোচনা গ্রন্থিত হয়েছে। এ মুহুর্তে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে প্রবন্ধ গ্রন্থ “বাংলাদেশের কবিতা : মুক্তপাঠ”, এবং গবেষণাগ্রন্থ “মুহাম্মদ আবদুল হাই এর ভাষাচিন্তা”। তিনি সম্পাদনা করছেন লিটলম্যাগ “পুবাকাশ” (২০০৫ থেকে)।
কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদের কবিতা ও গদ্যে বাংলা সাহিত্য বিকশিত হোক পাঠকের গোলায় উঠুক নতুন নতুন শব্দের সোনালী ধান।