চলে গেলেন নাট্যজন আলী যাকের
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ অভিনেতা নাট্যজন আলী যাকের আর নেই। শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, যাকের ভাই গত কয়েকদিন ধরেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
গত চার বছর ধরেই মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন এ অভিনেতা। শারীরিক নানা সমস্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে করোনা টেস্ট করা হলে পজিটিভ ফল আসে। গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার শ্যামলীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আলী যাকেরকে। সেখানে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। এছাড়া বার্ধক্যজনিত নানা রোগেও ভুগছিলেন এ গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের রতনপুর ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন আলী যাকের। গত ৬ নভেম্বর নিজ বাসায় ঘরোয়া আয়োজনে ৭৬তম জন্মদিন পালন করেন এ অভিনেতা।
১৯৬০ সালে সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক পাস করে নটরডেমে ভর্তি হন আলী যাকের। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। অনার্স পড়াকালেই ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। অনার্স শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে চলে যান করাচি। সেখানেই প্রথম অভিনয় করেন আলী যাকের। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় ফিরেন আসেন।
আলী যাকেরের জীবন যেন বিচিত্র জীবনের বর্ণচ্ছটা। অভিনয় তো বটেই নাট্য নির্মানেও ছিলেন তিনি অগ্রগণ্য। এছাড়া শৌখিন ফটোগ্রাফার হিসাবেও তিনি সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি ছিলেন। লিখেছেন বই। দৈনিক পত্রিকাতে তার শিল্প ভাবনা ও সমাজ ভাবনা তুলে ধরতেন তিনি অপকটে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উৎসারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশজাত শিল্প ভাবনা প্রেরণায়, ইউরোপীয় নাট্যরীতি প্রচলন ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আরণ্যক নাট্যদলে তার শিল্প জীবনে সূচনা হয়। নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক দিয়ে মঞ্চের জীবন শুরু হয়। এর পর থিয়েটারকে তিনি জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সময় নিজের সব্বোর্চ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসংগ্রামী ছিলেন তিনি। একাত্তরে আট নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আলী যাকের।
১৯৭২ সালের আলী যাকের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন; যার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। ওই দলে আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। আলী যাকের ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাভিশনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান ভালোবাসার বাংলাদেশ উপস্থাপনা করেন।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার আলী যাকেরকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক এবং মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন।
বরেণ্য অভিনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ নেওয়া হয়েছে রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তার নামাজে জানাজা আজ বাদ আসর বনানী কবরস্থান মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান ছেলে ইরেশ যাকের।
শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার মরদেহ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। আলী যাকেরের পরিবারের পক্ষ থেকে তার মরদেহের পাশে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের, ছেলে ইরেশ যাকের ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়া।