পাহাড়ি জীবনের গল্পে দূর পাহাড়ের দানো
ঔপন্যাসিক মোস্তফা মাহাথিরের লেখা ‘দূর পাহাড়ের দানো’। লেখকের আরো যে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও পড়েছি। এর মাঝে দু’টো কবিতার আর একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। কবিতা আর উপন্যাস দু’টোতেই কবি শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তুলেছেন শব্দের ঝঙ্কার। খেলেছেন শব্দ নিয়েই নানান ছন্দে।
দূর পাহাড়ের দানো। চমৎকার শব্দের গাঁথুনিতে নির্মিত হয়েছে কবির এই দ্বিতীয় উপন্যাসটি। বইয়ের শিরোনাম আর প্রচ্ছদ দেখেই পাঠক বুঝতে পারবেন এটি অ্যাডভেঞ্চারধর্মী একটি উপন্যাস। বলতে পারেন থ্রিলারও। একদম প্রথম থেকেই গল্পের শৈল্পিক বুনটে লেখক এক রোমাঞ্চকর ঘটনার ভেতরের দিকে টানতে থাকেন পাঠককে।
সহোদর ইভান-জিদানের দুষ্টুমি এবং তারানা নামক একটি রহস্যময় চরিত্রের উপস্থিতিতে রসঘন হয়ে ওঠে শুরুর দিকের পর্বগুলো। মনে হতে থাকে এই চরিত্রটিই হয়তো শেষপর্যন্ত গল্পের প্রধান চরিত্র থাকবে। কিন্তু না, গল্প এখান থেকেই একটা নতুন মোড় নেয় এবং অঞ্জু, অয়ন, ইভান আর ইরিনার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রের উপস্থিতে ঘটতে থাকে নতুন নতুন সব ঘটনা। আবার এইসব চরিত্রের আমাদের সামনে আসতে থাকে ফেলে আসা দিনগুলো। শৈশব উঁকি দেয় অজান্তেই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের স্কুল জীবনের কিংবা আমাদের শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা অধ্যায়গুলো। এছাড়া লেখক নানাভাবে বর্ণনা করেছেন শহুরে জীবন আর ছেলেবেলা।
জয়দেব বাবুর গল্পের রেশ ধরেই পাঠক গল্পের ভেতরে প্রবেশ করবেন। এখানেই লেখক তার উপন্যাসের মূল থিমটা ফুটিয়ে তুলেছেন সবিস্তারে। এই যে বিদেশি মিশনারী সংস্থা কর্তৃক জয়দেব বাবু আর নয়নকে কিডন্যাপ করা হলো, কিন্তু কেন? এটা ছিলো রহস্যের এবং উদ্বেগের একটা ব্যাপার। নাটকীয়ভাবে ঘটতে থাকে সব ঘটনা। একের পর এক।
আরেকটা অদ্ভুত চরিত্র সানজা মং। যদিও অনেকটা সহজ সরল আচরণ পাবেন সানজা মং চরিত্রে। কিন্তু তার ভেতরও যে এক অজানা ব্যথা চিনচিন করে বাজতে থাকে, তা কেন? পাঠককে অভিভূত করবে এই চরিত্রের মানবিক দিকটি। পুরো গল্পে মনু সিং আর গ্রুপের অন্য সদস্যরা ছিলো একেবারে সতর্ক এবং নিজেদের কর্মকৌশলে কঠোর। কে জানে তাদেরও হয়তো আলাদা আলাদা গল্প থাকবে কিংবা তারাও হয়তো বাঁধা পড়ে আছেন ভয়ানক এই ষড়যন্ত্রের অন্য কোনো শিকলে! কারা এরা কী তাদের পরিকল্পনা?
পার্বত্য অঞ্চলের নদী আর পাহাড়ে ঘেরা গহীন অরণ্যের ভেতর যে অন্ধকার কুঠুরিতে তাদের বন্দী করে রেখেছিলো, সেখানে কোন মানুষের বসবাস ছিলো না। কোন ঘরবাড়িও না। এমনকি কোন মানুষেরও বিচরণ নেই। একেবারে জনমানবহীন এলাকা। গহীন অরণ্য। এখানে সব বন্য পশুপাখি আর ভয়ঙ্কর পরিবেশ।
এমন ভয়ঙ্কর একটা অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ কাজ ছিলো না বন্দী জয়দেব স্যার এবং নয়নের কাছে। কিন্তু কিভাবে তারা মুক্তি পেলো? কিভাবে তারা ওই গহীন বন-পাহাড়ের ভেতর থেকে, নিশ্চিত মৃত্যুর থাবা থেকে বেরিয়ে আসে লোকালয়ে? শুরুর সেই রহস্যময় চরিত্র তারানার ভূমিকা প্রধান হবে বলে পাঠকের মনে হলেও আসলে অঞ্জু ও তার বন্ধুরাই প্রধান হয়ে ওঠে। বাইট্টা বাহিনী, ভিতর পার্টি কিংবা পাহাড়ের বিবদমান দুইটি সন্ত্রাসী গ্রুপেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘দূর পাহাড়ের দানো’র শিল্পকুশলী বর্ণনায়। আলফু মিয়ার উপস্থিতি অল্প সময়ের হলেও তাকে খুব শক্তিশালী চরিত্র বলে মনে হয়েছে।
লেখক মোস্তফা মাহাথির পাহাড়ের মানুষ। বইয়ের ফ্ল্যাপেও একথা বলা আছে যে, তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাহাড়ে। পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি মূলত তার পাহাড়েরই সার্থক প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠকের চোখের সামনে পাহাড়ি নদী-গিরি-পথের একটা সুন্দর দৃশ্য ভাসতে থাকবে অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে। লেখক পাহাড়ি জনপদ আর নদী-পাহাড়ের যে শৈল্পিক বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন, তা পড়ার পর ভ্রমণপিয়াসু মানুষ মাত্রই ছুটে যেতে চাইবেন পার্বত্য অঞ্চলে। লেখকের গ্রামে।
লেখক- মিজান ফারাবী, কবি ও প্রাবন্ধিক।