কীর্তিমান আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি-
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে দিচ্ছে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১’। এটি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এই পদক দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।
এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১’ এর জন্য মনোনীত (মরণোত্তর) হয়েছেন মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
চট্টলার অভিভাবক মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ও চার বারের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন এবং নবম জাতীয় সংসদে তিনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।
বর্তমানে তার উত্তরসূরি জ্যেষ্ঠপুত্র সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন-
আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থেকে রাজনীতি করেন। ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ চট্টগ্রামের জুপিটার হাউস থেকে ছাপিয়ে সর্বত্র বিলি করার ব্যবস্থা করেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়েন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তিনি দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমার বাবা। তিনি আজীবন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। দেশ ও দলের জন্য তিনি নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজ তারই স্বীকৃতি মিলেছে। আমার বাবার প্রতি রাষ্ট্রের এ সর্বোচ্চ সম্মানে আমি সন্তান হিসেবে এবং আমাদের পুরো পরিবার গর্ববোধ করছি।
মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র জীবনকাল-
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৪৫ সালের ৩ মে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী ও মায়ের নাম খোরশেদা বেগম। ১৯৫৮ সালে তিনি পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছর ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনার সময়ে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে যান। পরে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা প্রশাসনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ আসেন। এরপর ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন।
রাজনৈতিক জীবন-
চট্টগ্রামে আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিক ও সমাজসেবকের যেসব থাকা উচিত তাঁর সবই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মধ্যে ছিল। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন একজন মাঠের দক্ষ কর্মী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু । ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় কারাভোগসহ নির্যাতনের শিকার হন মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭০, ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র আলোয় আলোকিত হয়েছিল সমগ্র চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনীতি। আমৃত্যু আনোয়ারা কর্ণফুলীর মানুষের পাশে নিজেকে উজাড় করে গেছেন তিনি। বাঙালির সম্মান, গৌরব, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে যেসব রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক আখতারুজ্জামান চৌধুরী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা-
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণে ভূমিকা রাখেন মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন।
ব্যবসায়িক জীবন-
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তাঁর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। তিনি ছিলেন একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। স্বাধীনতার পূর্বে চট্টগ্রাম নগরীর বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্টসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়া জামান শিল্প গোষ্ঠী ও বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করেন এবং পরবর্তীকালে আরামিট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। একইসাথে তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসরকারী ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফা চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এবং ওআইসিভুক্ত দেশের চেম্বার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
পারিবারিক জীবন-
তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মেয়ে নূর নাহারুজামানকে বিয়ে করেন।মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ব্যক্তিজীবনে তিন পুত্র ও তিন কন্যাসন্তানের জনক।
মৃত্যুবরণ-
মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দীর্ঘদিন কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০১২ সালে ৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরিশেষ-
মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন চট্টগ্রামবাসীর অভিভাবক। একইসাথে ছিলেন আপন আলোয় আকিত একজন মানুষ। দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি। আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্য থেকে শুরু করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। দেশী টোয়েন্টিফোর পরিবার শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখা এই মহান মুক্তিযোদ্ধাকে। মহান এই মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণীয় করে রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে নির্মাণ করেছে “আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ফ্লাইওভার”। চট্টগ্রাম ও দেশের মানুষের ভালোবাসায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।