লিখছেন? কেন লিখছেন? কীভাবে লিখছেন?

0 355

একজন মানুষ কেন লেখে? এর একটা চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন,
“লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি। অন্য লেখকেরা যাই বলুন, আমার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, তাঁরা কেন লেখেন, সে প্রশ্নের জবাবও এটাই।”

আমি লিখি, কারণ দীর্ঘ কোনো কিছু লিখতে গিয়েই আমি মনের অতল গভীরে ডুব দিয়ে আসার সুযোগটুকু পাই। যে কোনো প্রডাক্টিভ কাজে ডুবে যাওয়াটা ডুবন্ত ব্যক্তির জন্যেই উপকারী। লিখতে গিয়ে মনের গভীরে ডুবে যাওয়ার এই মুহূর্তটুকু আমি বেশ উপভোগ করি।

নিজেকে ‘গল্পকার’ বললেও সে অর্থে গল্প লেখা হয়ে ওঠেনি। কবিতা তো আমার চর্চার ক্ষেত্রও নয়, তবুও লিখেছি অল্প ক’টি।

তবে বুকে হাত রেখে যদি বলতে হয়, তাহলে আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলব, আমি দীর্ঘ চিঠি লিখতে পারি। চিঠিতে নিজের কথার আধিক্য তো থাকেই, একই সাথে চিঠিতে নানা বিষয়ে আলোচনার একটা সুযোগও আমি পাই। তাই চিঠি রচনাতেও বেশ আনন্দ পাই।

লেখালেখির এই একটা নেপথ্য উপকারিতার উল্লেখের পরেও আমি সমবয়েসী ও অনুজদের সবসময়ই পরামর্শ দিয়ে থাকি, তারা যেন তাদের লেখার আগে নিজেদের পাঠ বাড়ায়।

সব বই-ই যে পড়ে যেতে হবে তা নয়। বেছে বেছে পড়ুন। প্রকৃত পড়ুয়াদের সান্নিধ্যে থাকুন। যিনি হুমায়ূনখোর, তার সান্নিধ্যেও থাকুন; যিনি ছফাখোর, এমনকি যিনি ক্ল্যাসিক সাহিত্যখোর, তার সান্নিধ্যেও থাকুন।

সমসাময়িকদের লেখা অবশ্যই পড়বেন। এখনও অনেক ভালো লেখক তৈরি হচ্ছেন, যাদের অনেকেই আন্ডাররেটেড। তবে লেখালেখির এ জগতে যারা সেলিব্রিটিজমকে প্রমোট করেছেন, তাদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে সেটা ভালো। কিন্তু ইতোমধ্যে আপনি কোনো সেলিব্রিটি লেখকের কাছের মানুষে পরিণত হয়ে থাকলে দূরত্ব সৃষ্টির প্রয়োজন নেই।

গান, নৃত্য- এসবকে বলা হয় গুরুমুখী বিদ্যা। কাউকে গাইতে বললেই সে গেয়ে ওঠতে পারে না। গলায় সুর না থাকলে, চর্চা না থাকলে কেউ গাইবে কী করে?

কিন্তু লেখালেখির ব্যাপারটাকে মানুষ এমনই অবহেলার চোখে দেখে যে, তারা ভেবে বসে, যে কেউই চাইলে লিখে যেতে পারবে। তাদের ধারণা, কোনো এক নির্মল, পাখপাখালি-গাছগাছালিময় পরিবেশে কাউকে বসিয়ে দিলেই সে যেন তরতর করে নৈসর্গিক গল্প-কবিতা লিখে যেতে পারবে। এই ভুল ধারণা নিয়েই তো  অনেকে লেখালেখিকে সস্তা মনে করে বসছে।

অথচ লেখাটাও একটা গুরুমুখী বিদ্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এর জন্যেও নিবিড় চর্চার বিকল্প নেই।

আজ একটা বই পড়ে কাল লিখতে বসে গিয়ে পরশু একটা মাসিক
পত্রিকা শুরু করে দেয়া লোকও আমি দেখেছি। এরা নিজেদের সাহিত্যমনা দাবী করে। কিন্তু সাহিত্যে যে তাড়াহুড়ো করতে নেই, এই ছবক তারা পায়নি।

কীভাবে পাবে? তারা যে সাহিত্যপাঠেই নিজেদের ডোবায়নি। কয়েকটা কাব্যগ্রন্থ আর উপন্যাস পড়লেই কি সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন সম্ভব? প্রবন্ধ তাহলে কোন প্রয়োজনে লেখা হয়েছে? আত্মজীবনীর কাজ কী তাহলে?

পড়বেন, চিন্তা করবেন, আবারও পড়বেন, এবং অতঃপর লিখবেন।

লেখালেখিকে ভয় পাওয়ার যেমন কিছু নেই, তেমনি একে পুতুলখেলাও ভাবতে নেই। লিখবেন নিজের সহজাত রীতিতে। লিখতে লিখতেই দেখবেন আপনার নিজস্ব একটি লেখনশৈলী তৈরি হয়ে গিয়েছে। তখন নিজেই উপভোগ করবেন নিজের লেখা।

প্রতিবার লিখতে গিয়েই বারবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, যে লেখাটি লিখছেন (গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ), সেটি কেন লিখছেন? সেটি থেকে একেক পাঠক কেমনভাবে প্রভাবিত হবেন?

প্রবন্ধ হলে পাঠক কি তা থেকে কোনো তথ্য পাবেন? কবিতা হলে পাঠক কি সেই কাব্যের রসে সিক্ত হবেন? গল্প হলে কি সেটির কাহিনী ও বাক্যবিন্যাসে স্বাতন্ত্র বজায় রাখা হবে?

এরপরেই লিখবেন। লেখা শেষে নিজের লেখার প্রথম পাঠক নিজেই হবেন, সাথে বিশ্লেষকও। “দারুণ লিখেছেন” টাইপ পাঠক কিংবা ‘অনবদ্য সাহিত্য’ টাইপ বিশ্লেষকদের মত হবেন না। বরং চুলচেরা বিশ্লেষণী পাঠকের মতই নিজের লেখাকে ব্যবচ্ছেদ করুন। (‘অনবদ্য’ শব্দের অর্থ নিখুঁত, ত্রুটিহীন। কোনো সাহিত্যই ত্রুটিহীন নয়)।

এভাবেই নিজেকে গড়ে তুলতে থাকবেন। শুধু একজন লেখক হওয়ার জন্যে তো আর লেখালেখি শেখা নয়। লিখতে জানলে সেটা আপনার কর্মক্ষেত্রেও অনেকভাবে ভূমিকা রাখবে। এটা একটা বাড়তি গুণ। প্রায় সকল গুণের মত এই গুণও আয়ত্ত্বে আনতে হয়।

আপনি কি এই চর্চায় নিজেকে নিবেদন করতে রাজি? তাহলে লেগে পড়ুন পাঠে, অংশ নিন সেসবের আলোচনায়। নিজে সমৃদ্ধ হোন। তাতে আপনার কাছের ও আশেপাশের মানুষেরাও আলোকিত হওয়ার সমূহ সুযোগ পাবে।

লেখক- তানসীর আলম, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.