বকুল তলার বিকেল

0 513
বন বিভাগ ডাক বাংলো

বন বিভাগের রেঞ্জ অফিস থাকায় দৃষ্টিনন্দন একটা ডাকবাংলো আছে আমাদের গ্রামে। আমরা যেমনটা মুভিতে, ক্যালেন্ডারে কিংবা ছবিতে দেখতাম ঠিক তেমনই। পুরো এলাকা জুড়ে বনাঞ্চল আর সুনশান নীরবতা ঘিরে আছে এই বাংলোর। এখানে মানুষের তেমন আনাগোনা নেই। নেই চলাচলের অবাধ কোন সুযোগ। মেইন রোড থেকে কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে যেই রাস্তাটা বাংলোর দিকে চলে গেছে তার শেষ প্রান্তে এই বাংলো। রাস্তাটাকে দেখতে বয়ে চলা নদীর মতো বাঁকিয়ে যাওয়া বলা যায়। রাস্তার দু’পাশ ধরে গর্জন, জাম, দেবদারু ও জারুল গাছের সারি। এই সারিতে বা তার ভেতরের দিকে নাম না জানা অনেক ধরণের গাছ লাগানো। এই সারি সারি গাছের মাঝে মাঝে রাস্তার পাশেই দেয়া আছে সোডিয়াম বাতি। যা রাতের দৃশ্যে সুন্দর দেখায়। কল্পোরাজ্যের মতো।

বাংলোর রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হেঁটে গেলেই বামে রেঞ্জ কর্মকর্তার বাসভবন ও অফিস কোয়ার্টার। তারপর কিছুদূর সামনে আগালে রাস্তার শেষে বিশাল এক চাপালিশ গাছ। এর নিছেই সুরম্য ইট, কাঠ ও টিনের তৈরি নান্দনিক বাংলোটা। এরপর আর রাস্তা নেই। গর্জন বাগানের মর্মর পাতার শব্দে কয়েক কদম হেঁটে গেলে একটা বৈঠকখানা আছে, যেটাকে আমরা গ্রামে গোলঘর বলি। তার পাশে পাহাড় আর ছায়া ঘেরা লেকের মতো দুইটা পুকুর। গোলঘরে বসে দেখা যায় জলে জলে ভেসে থাকা ডাহুক পাখি। শোনা যায় অরণ্যে ঘেরা থাকা পাখিদের ডাক।

বাবার বন বিভাগে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন অফিসে বা বাংলোতে বহুবার গিয়েছি। দেখেছি বহুমাত্রিক জীবনের গল্প। জানাশোনায় বেড়েছে অভিজ্ঞতা। জমে গেছে কতো মন ভোলা স্মৃতি। তবে, এখানের গল্প ও স্মৃতিটাই বেশি। এখানেই আমার বেড়ে উঠা জীবনের পটপরিবর্তন। অবশ্য বাবা কর্মরত থাকাকালীন করেরহাট রেঞ্জে বদলি হয়ে এসেছিলেন দু’বার। অফিসের কাছেই আমাদের বাড়ি হওয়াতে আমরা সরকারের বরাদ্দ দেওয়া কোয়ার্টারে থাকতাম না। বাবা থাকতেন মাঝে মধ্যে। এই অফিস থেকে বদলির পর আমৃত্যু আমাদের উপজেলার বিভিন্ন অফিসে কর্মরত ছিলেন।

গ্রামের বন্ধুরা জোট বেঁধে প্রায়ই বাংলার পুকুরে গোসল করতে যেতাম। হৈ-হুল্লোড় করে দিন কাটিয়ে দিতাম। অফিসে শাল বাগানের মাঠে খেলতাম ক্রিকেট। সারা গ্রাম আর অফিস এলাকা চষে বেড়াতাম কৈশোরে। সে সময় গ্রামে খেলাধুলায় মত্ত থাকা কিংবা কাছে থাকা সঙ্গীদের একজন হলো রুবেল। সম্পর্কে ফুফাতো ভাই। আমরা শৈশব থেকে ভালো বন্ধুও বটে। আমি আর রুবেল রাতেও বাংলা পাড়ায় মাঝে মাঝে হাঁটতে যেতাম। সোডিয়াম বাতির আলোর প্রতি তখন থেকেই ভালোলাগা কাজ করতো। মন চাইতো বাংলোর রাস্তায় হেঁটে হেঁটে গল্প করে রাত পার করে দিবো। কিন্তু তখন সেই সুযোগ ছিলো না।

কৈশর পেরিয়ে যখন যৌবনে পা রাখি সেই সময়টাতে বিকেলে হাঁটতে বের হতাম। প্রায়ই বকুল তলা আর বাংলোতে যেতাম আমি আর পারভেজ। আমরা দু’জনই গ্রামের শৈশব-কৈশোরের মাঝামাঝি সময়ের সাথি। আমরা বাংলো বা অফিস কোয়ার্টারের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে (তখনো মোবাইলের প্রচলন তেমনটা ছিলো না বলে আমরা দিনগুলো বেশ গল্পে-আড্ডায় দারুণ উপভোগ করতাম) নার্সারি পেরিয়ে বকুল তলায় পৌঁছাতাম। বকুল গাছের আশেপাশে ছিলো অনেকগুলো জলপাইয়ের গাছ। যেগুলোর ডালপালা নিচ থেকেই বিস্তৃত হওয়াতে অনায়াসে বসা যেত। আমরা এখানে বা বাংলার বারান্দায় বসেই গান গাইতাম, গল্প করতাম, যৌবনে প্রেমের ফুল ফোটা বয়সে কী কী বলতাম তা এখন আর মনে নেই। শৈশব-কৈশোরের কতো কতো স্মৃতি বুকে নিয়ে বয়ে চলা দিন আমাদের।

এই দিনযাপনের সময়ে আমাদের গ্রামে হুদা নামে আমার এক বন্ধু লজিং থাকতো। কাঠের ব্রিজের ওখানে। এই ব্রিজের নীচ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড় থেকে নেমে আসা লক্ষীছড়া। তার পাশেই টিন শেট একটা ঘরে। জায়গির আসার পর থেকে মাঝে মাঝে বিকেলে তার সাথেও আমার বাংলোর গোলঘরের দিকে যাওয়া হতো প্রায়। আমরা গান গাইতাম প্রাণ খুলে। সে বছর দুয়েক ছিলো আমাদের গ্রামে। এর মাঝে আমিও শহরে চলে যাই। সে কখন চলে গেলো আর টের পাইনি। এখন আর দেখাটেখাও হয় না। কেমন আছে? কোথায় আছে? সেই খবরটুকুও জানি না। খুব মিস করি তারে।

গ্রামে আসলে কারো দেখা পাই না এখন। কতোজন হারিয়ে গেলো স্মৃতির জীবন থেকে। শৈশব-কৈশরের বন্ধুদের অনেকেই জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। আর কেউ বা চাকরিতে শহরে-বন্দরে। গ্রামে কেউ কেউ থাকলেও তেমন দেখাটেখা হয় না। যে যার যার মতো জীবন সংসারে টিকে আছে নানান কায়দা করে।

আমি গ্রামে এলে বকুল তলায় বা বাংলোর দিকে এখনো ছুটে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে পুষে রাখি মনে। কিন্তু সুযোগের অভাবে হয়ে উঠে না। আবার তেমন সঙ্গীও পাই না। কেউ কেউ যায়, সঙ্গ দেয়, গল্প করি। এবার গ্রামে এসে রনি সাহাকে বলতেই বিকেলে আমার সাথে বকুল তলায় গেলো। বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে দিলো সে। স্মৃতি কাতর হয়ে অনেক গল্প করলাম রনির সাথে। বকুল তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়লাম, স্মৃতিরা আমাকে কেমন যেন এলোমেলো করে দিলো। চারিদিকে তাকাতেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। আগের চেনা সেই রূপ ও প্রকৃতির তেমন কিছুই নেই। নেই জলপাইয়ের গাছগুলো। বদলে গেছে বকুল তলার চারপাশের পরিবেশ।

বকুল তলা আমার বহুদিনের পুরনো জায়গা। কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার চারপাশে। কতোবার যে গিয়েছি তার ইয়াত্তা নেই। এখনো মাঝে মাঝে গ্রামে এলে বকুল তলায় বা ডাকবাংলোর দিকে হাঁটতে যাই। জীবনের কিছু অধ্যায়ের স্মৃতি জমা রেখে বেড়ে চলে আমার দিনযাপন। এখনো জীবনকে খুঁজে ফিরি অতীতে, হৃদয়ে স্মৃতির গল্পে।

“আমার গ্রামে কে শোনালো ওই বকুল তলার সুর,
কে টানে আমায় বাঁশরির সুরে সকাল-দুপুর…।”

 

লেখক- মিজান ফারাবী, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.