অমানবিকের জন্য মানবিক হয়েছি: প্রধানমন্ত্রী

0 424

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  ‘আমার মনে হয় এই প্রশ্ন করার জন্য আপনাদের লজ্জা হওয়া দরকার। যারা আমার বাপ-মা, ভাই, আমার ছোট রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করিয়েছে। তারপরও আমরা অমানুষ না। অমানুষ না দেখেই তাকে (খালেদা জিয়া) তার বাসায় থাকার ব্যবস্থাটুকু আমার এক্সিকিউটিভ অথরিটিতে, আমার হাতে যতটুকু ক্ষমতা আছে, সেটুকু দিয়ে তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

গত বুধবার গণভবনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও ফ্রান্স সফরপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন শেখ হাসিনা। লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর সম্পর্কে অবহিত করতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকরা যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হল থেকে। গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে জিয়ার সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর সম্পর্কে অবহিত করতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকরা যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শাপলা হল থেকে।

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার পর আমাদের এতজন আহত। ২২ জন মারা গেছে। একদিনও পার্লামেন্টে সেটার ওপর আলোচনা করতে দেয়নি। যে এত বড় অমানবিক তাকেও আমরা মানবতা দেখিয়েছি।‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমার অথরিটিতে বাসায় থাকতে দিয়েছি। বাকিটা আইনের ব্যাপার। এতবড় অমানবিক যে, তাকে আমি মানবতা দেখিয়েছি। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান?’

 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় যা করার ছিল, তা তিনি করেছেন, এখন বাকিটা ‘আইনের ব্যাপার।

‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান? আমাকে বলেন। এখন সে (খালেদা জিয়া) অসুস্থ। ওই যে বললাম না, রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কে? সেটি মনে করে বসে থাকেন। এখানে আমার কিছু করার নাই। আমার যেটা করার ছিল করেছি। এটা আইনের মাধ্যমে।’

 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিষয়ে খালেদা জিয়া সরকারের কর্মকান্ড তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাকে যদি কেউ হত্যা করার চেষ্টা করত আপনি কি গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন বলেন আমাকে? বা পরিবারের কেউ যদি হত্যা করত আর সেই হত্যাকারীদেরকে কেউ বিচার না করে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত তাদের জন্য আপনি কী করতেন?

 

‘আমি থাকতে হত্যাকারীকে ১৫ ফেব্রুয়ারির ৯৬ সালের ইলেকশনে ভোট দিয়ে পার্লামেন্টে বসানো… যেখানে আমি বিরোধী দলের নেতা ছিলাম, সেখানে বসানো হলো কর্নেল রশিদকে (খন্দকার আবদুর রশিদ)। কে করেছিল? খালেদা জিয়া।’

 

‘খায়রুজ্জামান আসামি। তার মামলার রায় হবে। চাকরি নাই। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই আসামিকে চাকরি দিল ফরেন মিনিস্ট্রিতে। রাষ্ট্রদূত করে পাঠাল। বাশার একজন খুনি, মারা গেছে। মৃত ব্যক্তিকে প্রমোশন দিয়ে… সে সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল। তার সমস্ত অবসর ভাতা সব দিয়ে দিল।’

 

প্রসঙ্গত, ৭৬ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। গত ১৩ নভেম্বর থেকে তিনি বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি। তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবারও সরকারের কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু দণ্ড স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেহেতু তাকে এখন বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি যদি কারাগারে ফিরে গিয়ে আবেদন করেন, সরকার তখন তা বিবেচনা করতে পারে।

 

আর কত ভর্তুকি চান?

 

সরকার প্রতি বছর ডিজেলে ২৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তেল, বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাত মিলিয়ে সরকারকে প্রতি বছর ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, এমন তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেছেন, সরকার আর কত টাকা ভর্তুকি দেবে? তিনি আরও বলেছেন, বাজেটের সব টাকা যদি ভর্তুকিতে দিয়ে দেই তাহলে সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, তা নিয়ে আমরা সব সময় সচেতন। করোনাকালে গ্রামপর্যায় পর্যন্ত কৃষক থেকে শুরু করে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যাদের আমরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করিনি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। উৎপাদন বাড়ানোর সব ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। আমাদের তেল কিনে আনতে হয়। উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন কত টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়। পরে তিনি নিজেই উত্তর দেন। তিনি বলেন, ২৩ হাজার কোটি  টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়। বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকি।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকদের জন্য সারের দাম আমরা কমিয়েছি। যে সার ৯০ টাকা ছিল তা কমিয়ে ১৫-১৬ টাকা করেছি। কৃষিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছি। কার্ড করে দিয়েছি। এখন কৃষক ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। যার মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি তাদের কাছে যায়। তিনি বলেন, করোনার সময় ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি। সুদের হার কমিয়ে অর্ধেক সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক থাকে। শ্রমিকরা যাতে বেতন পায় তার ব্যবস্থা করেছি।

 

অনেক উন্নত দেশ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, লন্ডনে সুপার মার্কেটে সাপ্লাই নেই। খাবার জিনিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশে কোনো খাদ্যের হাহাকার নেই।

 

সবাই টাকা উপার্জন করে ট্যাক্স কতজন দেয়? বাস ও অন্যান্য পরিবহনের ভাড়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেশে ছিলাম না ঠিক, তবে দেশের সঙ্গে ছিলাম না তা তো নয়। ডিজিটাল যুগ। বিভিন্ন মাধ্যমে বারবার যোগাযোগ হয়েছে। যারা ভাড়া বাড়াচ্ছিল তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এরপর একটি যৌক্তিক পর্যায়ে ভাড়া রাখা হয়েছে।

 

আমাদের বিদ্রোহীদের হয়তো সমর্থন দিয়ে উসকে দেওয়া হচ্ছে

 

ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে সরকার প্রধানের অভিমত, শুধু চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রতীক দিচ্ছি বলে সংঘাত হচ্ছে তা নয়। মেম্বারদেরও নির্বাচন হয়। সেখানে কোনো প্রতীক থাকে না। এ সময় বিএনপিকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা যেহেতু দলীয়ভাবে নির্বাচন করছে না তাই তাদের দলের নাম আসছে না। সেদিক থেকে তাদের চালাকিটা ভালোই। ভালো একটা চালাকি তারা করে দিয়েছে। ইলেকশনও করছে, আবার মারামারিও করছে। আবার উসকিয়েও দিচ্ছে। আমাদের বিদ্রোহীদেরও হয়তো সমর্থন দিয়ে উসকে দিচ্ছে।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দলীয় প্রতীক দেওয়ার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘাত হচ্ছে কথাটি ঠিক নয়। তবে কোনো সংঘাত গ্রহণযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগের কেউ কোনো সংঘাতে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

 

১৯৭৭ সালের সেনা হত্যাকাণ্ড গুরুত্ব দিয়ে দেখবে সরকার

 

পঁচাত্তরপরবর্তী সামরিক বাহিনীতে হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে অনেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই সব সেনা কর্মকর্তার স্বজনদের খোঁজ নেবে সরকার। তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের সেনা হত্যাকাণ্ড সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। এতদিন এটা নিয়ে তেমন কথা হয়নি। আপনারা এ বিষয়গুলো নিয়ে এখন কথা বলছেন, এটা ভালো।

 

১৫ আগস্টে স্বজন হারানো পরিবারগুলোকে মামলা করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমার বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে আমি মামলা করতে পারিনি। মামলা করতে দেওয়া হয়নি।১৯৭৫ সালের পর থেকে প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ হত্যা হয়েছে সেটা এখনো জানা নেই। আমি অনেক পরিবারের কাছে গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের আর্তনাদ শুনেছি।

 

বিশ্বকাপ নিয়ে আমি হতাশ নই, আপনারা কেন?

 

আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সে হতাশার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বিশ্বকাপের হতাশাজনক খেলা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলা দেখে আপনারা এত হতাশ হন কেন? আমি হতাশা দেখতে চাই না। কয়েকটা খেলা তারা চমৎকার খেলেছে। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্রিকেট খেলেছেন কখনো, মাঠে গেছেন কখনো? ব্যাট-বল ধরেছেন? ধরেননি। সেজন্য জানেন না। কথায় কথায় এত হতাশ হওয়া ঠিক না। এটা আমাদের একটা রোগের মতো হয়ে গেছে, একটুতেই হতাশ, একটুতেই উৎফুল্ল। মাঝেমধ্যে ধৈর্য ধরে থাকেন। আগামীতে আরও ভালো করবে তারা। তিনি বলেন ‘হ্যাঁ, ফলাফল যেটা আমরা আশা করেছিলাম সেটা হয়নি। তবে এজন্য আমি আমাদের ছেলে-পেলেদের নিয়ে কখনো হতাশা প্রকাশ করি না। আমি বলি আরও ভালো খেল। আরও প্র্যাকটিস করো।’

 

২৫ কোটি ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে, সবাইকে দেওয়া হবে

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন পর্যন্ত দেশের ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে। ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। কেউ ভ্যাকসিন থেকে বাদ যাবে না। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। অনেক দাম দিয়ে ২৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনেছি। শুধু করোনার টেস্ট বাবদ খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৮-৯ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। বাকিদের প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। কেউ ভ্যাকসিন থেকে বাদ যাবে না।

 

প্রধানমন্ত্রী ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত গ্লাসগো, লন্ডন ও প্যারিসে সরকারি সফরকালে কপ-২৬-এ বিশ্বনেতাদের শীর্ষ সম্মেলন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২১, ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান, ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ সম্মেলন, প্যারিস শান্তি ফোরাম, ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.