শাহেদের সাথেও অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা ছিল ডা. সাবরিনার।
শাহেদের সাথেও অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা ছিল ডা. সাবরিনার।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদের সঙ্গে জেকেজি’র চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা একে অপরকে আগে থেকেই চিনতেন। নিয়মিত পার্টিতে অংশ নিতেন। সেই পার্টিতে চলতো ডিজে-মাদকতা। শাহেদ-সাবরিনা ছাড়া সেই পার্টিতে সমাজের আরো অনেক চেনামুখ অংশ নিতেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে শাহেদ ও সাবরিনা একে অপরকে জানাশুনার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। দিয়েছেন আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। করোনা সনদ জালিয়াতির আইডিয়া শাহেদের কাছ থেকে পেয়েছেন সাবরিনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কাজ ভাগিয়ে নিতে ব্যবহার করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠনের একাধিক চিকিৎসককে। এ ছাড়া এক ব্যবসায়ীর হোটেল জোরপূর্বক দখল করে ব্যবসা করতেন শাহেদ। করোনাকালে দখল করা সেই হোটেলটি সরকারকে দিয়েছিলেন।
গোয়েন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা ৬ নং সেক্টরের পার্কের পাশের মিলিনিয়াম রেস্টুরেন্টটি রাজবাড়ীর এক বাসিন্দার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাপানে ছিলেন। জাপানি এক নারীকে বিয়েও করেছেন। তার স্ত্রী ও এক মেয়ে জাপানেই থাকে। দেশে এসে তিনি ওই রেস্টুরেন্টটি করেন। পরে ২০১৯ সালে যৌথভাবে ব্যবসার জন্য রিজেন্টের শাহেদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। চুক্তিতে বেশকিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন। শর্তের মধ্যে ছিল শাহেদকে মাসে মাসে একটা ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কিছুদিনের মাথায় শাহেদ সেই হোটেলের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। হোটেলের মূল মালিককে হোটেলে ঢুকতে দিতেন না। হোটেলটির নিচে খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে জাপানি খাবারের আয়োজন করা হতো। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাপানি খাবার পছন্দ করতেন। তাই তিনি ওই রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে যেতেন। সেখানে শাহেদের সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। শাহেদের দখল করা হোটেলের উপরে আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। তাই প্রায়ই সেখানে আমোদ ফুর্তি ও মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হতো। বিত্তশালীদের আনাগোনা ছিল বেশ। সাবরিনা প্রায়ই এসব পার্টিতে অংশ নিতেন। এরপর থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। পুলিশ জানিয়েছে, শাহেদ কিছুদিন হোটেলটি তার কব্জায় রেখে পরিচালনা করেছেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ওই হোটেলটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেন। শাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালটি ছিল করোনা ডেডিকেটেড। তাই সেখানকার চিকিৎসক-নার্সদের সেখানেই রাখা হতো। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জোরপূর্বক দখল করে নেওয়াতে হোটেলের মূল মালিক উত্তরা পূর্ব থানায় শাহেদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেছিলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার খন্দকার রেজাউল হাসান মানবজমিনকে বলেন, শাহেদ হোটেলের মূল মালিককে বিতাড়িত করে দখল করে নেয়। করোনাকালে ওই হোটেলটি সরকারকে দিয়ে দেয়। হোটেলটিতে চিকিৎসক-নার্সরা থাকতেন। শুনেছি করোনার জন্য হোটেল বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টাকা নিয়েছে। তবে আসলেই টাকা তুলেছে কিনা সেটি জানি না। বর্তমানে হোটেলটিতে খাবার ও আবাসিক কোনো ব্যবস্থাই চালু নাই বলে জানান তিনি।
রিমান্ডে সাবরিনার চাঞ্চল্যকর তথ্য: এদিকে রিমান্ডে ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী প্রথম দিকে মুখ না খুলে একে অপরকে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদে এখন তারা মুখ খোলা শুরু করেছেন। একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা। তারা তাদের সকল অপকর্মের কথা স্বীকার করেছেন। এসব অপকর্মের জন্য কিছুটা অনুশোচনাবোধও হচ্ছে তাদের। ডিবি’র জেরার মুখে সাবরিনা ও আরিফ তাদের সহযোগীদের নাম জানিয়েছেন। কারা তাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিনিময়ে তাদেরকে কি দিতে হয়েছে। ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা ও আরিফ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে অন্তত আটজন কর্মকর্তার নাম বলেছেন।
ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা জানিয়েছে, ওভাল গ্রুপের মাধ্যমে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনেক কাজ আগে থেকেই করতো। চিকিৎসক নেতাদের মাধ্যমে তারা সেই কাজ পেয়েছিলো। আরিফ সেসব কাজ পরিচালনা করলেও সাবরিনা কাজ পাবার ব্যবস্থা করতো। এ ভাবে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এজন্য করোনা পরিস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহের আইডিয়া পাবার পর তারা খুব সহজেই কোনো রকম কাগজপত্র, ট্রেড লাইসেন্স ও অফিস ছাড়া কাজ বাগিয়ে নেয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের সহযোগী ও মদতদাতাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্ত করা হবে। করোনার মতো জটিল পরিস্থিতিতে তারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে। জাল সনদ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা নিয়েছে। তাই এধরনের কাজে যারা যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হবে। এর বাইরে ওভাল গ্রুপের কিছু পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জেকেজিতে চাকরি করতো এমন কয়েকজন পলাতক আছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, সাবরিনা ও আরিফের মদতদাতা একাধিক ব্যক্তির নাম জানতে পেরেছি। তারা নিজেরাই এসব নাম বলেছে। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন। চিকিৎসক নেতাও আছেন। তাদের দেয়া নামগুলো নিয়ে এখন আমরা যাচাই বাছাই করে দেখছি আসলেই তাদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা। যদি আমাদের তদন্তে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবো। তিনি বলেন, সাবরিনা ও আরিফ তাদের সমস্ত অপরাধ স্বীকার করেছে। তারা এও বলেছে প্রতারণা থেকে প্রাপ্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিতে হয়েছে। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। রিজেন্ট ও জেকেজি’র এই ঘটনা যদি ধরা না পড়তো তবে বুঝতেই পারতাম না স্বাস্থ্য সেক্টরের এমন অবস্থা।
ওদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আবদুল বাতেন শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে বলেছেন, জেকেজি হেলথ কেয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কাজ পাবার জন্য ব্যবহার করেছে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর ফেসভ্যালু। জেকেজি জালিয়াতির প্রধান অস্ত্র ছিল সাবরিনা। অধিদপ্তরে তার ফেসভ্যালু ব্যবহার করে জালিয়াতি ও নানা ধরনের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। তবে এসব কাজ সে একা একা আনা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মকর্তার সহযোগিতা প্রয়োজন হয়েছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমরা একে একে সবাইকে ডাকবো।