তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে
এই যে দেশ ও সমাজে যারা সুবিধাবাদী বা যারা অন্যের সমালোচনা করেন, হিংসায় কাতর হয়ে পড়েন কিংবা পরনিন্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আপনারা এসব বাদ দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যান। যার যার অবস্থান থেকে, যারা যেই সেক্টরে আছেন সেখান থেকে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে যান। কাজ করলেই, আপনি এগিয়ে যাবেন। আপনার পরিবার, সমাজ, একইসাথে এই দেশ এগিয়ে যাবে। আর এভাবেই দেশ ও সমাজ এগিয়ে যেতে যেতে আপনি টিকে যাবেন মানুষের মনে। এই পরিবার, সমাজ ও দেশ থাকবে, আপনি থাকবেন না। আপনি মরেও মানুষের মননে টিকে যাবেন, তাদের হৃদয়ের স্মরণে।
সুতরাং, আজ ও আগামীদিনের কথা মাথায় রেখেই পথচলা শুরু করুন। তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে প্রযুক্তি ও জ্ঞান নির্ভর অথবা কারিগরি শিক্ষার [ হাতেকলমের ] কাজটাই শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। এর বাইরে এসে ছদ্মবেশী যতো আকাম করবেন এসবে টিকে থাকা যাবে না। মনে রাখবেন, এতে করে দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখা যাবে না। শুধুমাত্র এলিট সোসাইটির কথা ভাবলে চলবে না। একইসাথে ভাবতে হবে দেশের প্রান্তবতী মানুষের কথাও। এখানে শুধু কেউ কেউ মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে কাজ হবে না।
কারণ, বক্তৃতা নয়। আপনার কাজই প্রমাণ করে দিবে আপনি দেশ ও মানবতার সেবায় কতটুকু আগালেন বা আন্তরিক হয়ে কাজ করলেন। জনগণের কাছে এটাই মুখ্য বিষয়। দেশের দরিদ্র ও আলাদা কোন জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে একটি দেশের সার্বিকভাবে উন্নয়ন সাধিত হয় না। বড়জোর স্বার্থবাজ একটি মহল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ত্রান ও দানের টাকা হাতিয়ে নিজেদের এলিট ভাব ধরে থাকতে পারবে। আদতে দেশের দরিদ্র বা অসহায় মানুষের যতোদিন আর্থিক সংকট দূর করা যাবে না বা এর উপায় বের করে সমাধানের পথে হাঁটবে না ততোদিন এই দেশ শিক্ষা ও অর্থনীতিতে এগিয়ে যেতে পারবে না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই, আমি দেশের উত্তরাঞ্চলে ভ্রমণে গিয়ে একটা সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। সবাই মিলেমিশে সাইকেল নিয়ে ইশকুল বা মাদ্রাসায় যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরা বিস্তীর্ণ জল-জমি পেরিয়ে সাইকেল চালানোর এই দৃশ্য দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। এই যে ছেলেমেয়েরা সাইকেল নিয়ে দূরদূরান্তে শিক্ষার জন্য ছুটছে এটা যেমন সুখের তারচে বেশি দুঃখের। এর মূল কারণ হলো, ওখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ জনপদ থেকে অনেক দূরে। তাদের পড়ালেখার খরচ এবং দৈনন্দিন গাড়ি ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য ওদের নেই। এরসাথে পারিবারের আর্থিক পিছুটান তো আছেই। ওখানকার শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই কৃষি পেশায় জড়িত। এমনকি সুযোগ পেলেই ছেলে ও মেয়েরা হালচাষের মাঠেই পড়ে থাকে সারাদিন। এভাবেই নানান কাজের সাথে জড়িত ওরা।
এই উত্তরাঞ্চলের মানুষরাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করে থাকে বছরের পর বছর। তবে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে কিছু কিছু সংস্থা কাজ করলেও তাতে যথাযথ যোগান দেয়া যায় না। এর জন্য ব্যাপকভাবে সামাজিক সংস্থা, এনজিও বা দেশের শিল্পপতিদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করি। এই যে প্রান্তিক মানুষদের দূরাবস্থা এটা কোন গ্রাম বা উপজেলাকে কেন্দ্র করে দেখলে বুঝা যাবে না। এটা উপলব্ধি করতে দেশের দূর্যোগ প্রবণ এলাকা বা উত্তরাঞ্চলের দিকে তাকালেই এই দৃশ্য প্রতীয়মান হবে। এটাতো শুধু দেশের উত্তরাঞ্চলের কথা বললাম, মূলত এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা দেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। এটার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে [ অবশ্য, তা একদিনে হয়ে উঠবে না। এর জন্য সময় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায়] এর সমাধান করতে হবে, শুধু ত্রান বা দান করলে হবে না। এদেরকে এককালীন অনুদান দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। তবেই একটি দেশের জনগণ সাচ্ছন্দ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করি।
আরো দেখুন:
তো কথা হইলো, দেশকে এগিয়ে নেয়া কোন রাষ্ট্রের শুধু প্রধানমন্ত্রীর একার দ্বায়িত্ব না। সামগ্রিকভাবেই আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের যে কোন কাজে আমাদেরকেই অংশগ্রহণ করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিজ্গান ও প্রযুক্তিতে, কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসায় বলেন, সংস্কৃতিতে বলেন কিংবা অন্যান্য অংশে বলেন দেশে যারা রাষ্টচিন্তক, সমাজচিন্তক অথবা নানান পেশার সাথে জড়িত সবার সহযোগিতা ও সমাজভাবনা প্রয়োজন। বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, দেশে বিদেশি সংস্থাসহ আজ হাজারো সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে।
এটা ভালো এবং আগামীদিনের সম্ভাবনার দিক। তবে কথা হলো, এই যে দেশের প্রান্তিক জনপদ নিয়ে বিশাল একটা গোষ্ঠী কাজ করে যাচ্ছে এদের সাথে স্থানীয় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী কিংবা লিডিং পর্যায়ে যারা আছেন তাদের সাথে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এই কাজগুলো সম্ভাবনা ও সুখের হয়ে উঠবে তখনই, যদি সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সমাধানের জন্য সমন্বয় করা যায়। অন্যথায়, সমন্বয়হীন এভাবে বছরের পর বছর কাজ করে গেলেও কিছু মানুষের হয়তো উপকার হবে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশ ও জনপদের যে কল্যাণ তা হয়ে উঠবে না।
বলাবাহুল্য যে, আমাদের সমাজে একে অন্যের ভালো আমরা চাই না। সমাজে একজন ব্যক্তি যখন শত আপদ মাড়িয়ে সফলতায় পৌঁছায়, মানুষরা তারে সাধুবাদ বা শুভেচ্ছা জানায়। কিন্তু তার এই সফলতার পেছনে [ কেউ কেউ সহযোগিতা করেন, এদের সংখ্যা সামান্য ] সমাজের বাকিরা সহযোগিতা বা উৎসাহ যোগায় না। বরং পরিস্থিতি এমন হয় যে, কারো ভালো কাজ বা উদ্যোগ দেখলে এই মানুষরা হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। অথচ এই গাছবলদরা বুঝতে চায় না যে, কোন মানুষের ভালো কাজ কিংবা সৃজনশীল কোন উদ্যোগ পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের জন্যই কল্যাণ ও সুনাম বয়ে আনে।
সুতরাং, এই পরশ্রীকাতরতায় না ভুগে দেশ ও সমাজের জন্য নিজেই কাজ করে যান। একইসাথে সমাজ ও দেশে যারাই ভালো কাজ করবে, তাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী যার যার অবস্থান থেকে পরামর্শের মাধ্যমে, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে কিংবা যে কোন মাধ্যমে হোক সহযোগিতা করা প্রয়োজন। আসুন, সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ ও দশের জন্য কাজ করি। আর যদি তাও করতে না পারেন, তাহলে এই চিত্তদাহ বাদ দিয়ে নীরবতা পালন করাই শ্রেয় হবে।
লেখক- মিজান ফারাবী, কবি ও প্রাবন্ধিক।