মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার প্রবর্তক মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী(ক.)

বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহীম

শেষ যুগের মোজাদ্দেদ, বিগত আগত যুগসমূহের মধ্যস্থকারী এই পৃথিবীতে শেষ নবীর অবয়বপ্রাপ্ত শেষ প্রতিনিধি, আল্লাহ্র জাতি নাম এবং নবীজীর জাতি নামে সংমিশ্রিত বিশ্ব মেরুর মধ্যধামে আবির্ভূত সেই সু-মহান মহাপুরুষ মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার প্রবর্তক গাউসুল আযম খাতেমুল অলদ হযরত মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর সংক্ষিপ্ত জীবন-দর্শনের আলোকপাত।

“কুলকুল্লুম মুতারাব্বিসুন ফাতারাব্বাসূ ফাছাতা‘লামূনা মান আসহা-বুসসিরা-তিছ ছাবিইয়ি ওয়া মানিহতাদা”

অর্থঃ বলুন, প্রত্যেকেই পথপানে চেয়ে আছে, সুতরাং তোমরাও পথপানে চেয়ে থাক। অদূর ভবিষ্যতে তোমরা জানতে পারবে কে সরল পথের পথিক এবং কে সৎপথ প্রাপ্ত হয়েছে। (সূরা ত্বোয়া হা-১৩৫)

আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় মাহবুব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতবা (দ.) এঁর প্রতি দুইটি সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত অর্পণ করেন যার একটি নবুয়ত আর অপরটি বেলায়ত। তিনি খাতেমুন্নবী হন বিধায় তাঁর ওফাতের পর নবুয়াতের যুগ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বেলায়ত অসীম এবং চিরন্তন। আর এই মহান বেলায়তের প্রবাহধারা সুফী সাধক অলী কামেলদের মাধ্যমেপৃথিবীতে আবহমানকাল জারী থাকবে। সে প্রবাহমান বেলায়তের প্রবাহধারা পর্যায়ক্রমে প্রবাহিত হয়ে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের অধ্যাত্ম শরাফতের প্রতিষ্ঠাতা মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকারপ্রবর্তক প্রাণপুরুষ হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী শাহ্ সুফি মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর জাতে পাকে বিকাশ লাভ করে।

মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ : বারআউলিয়ার পুণ্যভূমি খ্যাত চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত মাইজভাণ্ডার একটি গ্রাম। যাহা ধর্মের মর্মবাদ ও কর্মবাদ সমুদয়ের সমাবেশকারী সমন্বয় সাধক অলী উল্লাহর আবাসভূমি নামে অভিহিত। হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর অধ্যাত্ম শরাফত এর মহিমায় মাইজভাণ্ডার গ্রামখানি ‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ’নামে আজ সারা বিশ্বে অন্যতম পবিত্রতম স্থান হিসেবে পরিচিত।

এ প্রসঙ্গে জৈনপুরী দরবার শরিফের তৎকালীন সাজ্জাদানশীন পীর, মওলানা শাহাবুদ্দিন সাহেবের প্রশ্ন “আপনার দরবারে বহু ‘মসরবের’মানুষ দেখিতেছি”এর উত্তরে হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.) বলেছিলেন “মিঞা! যিছ দোকানমে হারচিজ রাহতা-হ্যায় ওয়ে আচ্ছা হ্যায়।”(গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর জীবনী ও কেরামত)

জন্মতথ্য : রাসূলে করিম (দ.) এঁর পবিত্র বংশ সম্ভূত হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত ফটিকছড়ি থানার মাইজভাণ্ডারে  ১৮২৬ ইংরেজি, ১২৪৪ হিজরী, ১১৮৮ মঘী, ১ মাঘ, বুধবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা শাহ্ সুফী সৈয়দ মতি উল্লাহ এবং মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা বিবি। দাদা সৈয়দ তৈয়ব উল্লাহ্ তৎ পিতা সৈয়দ আতা উল্লাহ তৎ পিতা সৈয়দ আব্দুল কাদের, তৎ পিতা সৈয়দ আব্দুল হামিদ গৌড়ি ১৫৭৫ ইংরেজি বংশলতিকা এভাবে রাসূল পর্যন্ত পৌঁছে। প্রসঙ্গত, তাঁর মাতুলবংশ ও সৈয়দ বংশী তাঁর নানা সৈয়দ সানাউল্লা মোমেন শাহ্ হাপানীয়া, ভূজপুর ফটিকছড়ি নিবাসী যাঁর অপর ভ্রাতা সৈয়দ জয়নুল্লাহ্ মোমেন শাহ্ হাটহাজারী থানার মির্জাপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

শিক্ষা জীবনঃ তিনি গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনান্তে ১২৬০ হিজরী সনে কলিকাতায় আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তথা হতে ১২৬৮ হিজরী সনে বিশেষ কৃতিত্বের সহিত শেষ পরীক্ষায় পাস করেন। কুরআন, হাদীছ, তফছীর, ফেকাহ, মন্তেক, বালাগত,উছুল, আকায়েদ, ফিরছফা ও ফরায়েজ প্রভৃতি শাস্ত্রে তিনি বিশেষ জ্ঞান অর্জনে কৃতিত্ব লাভ করেন।

কর্মময় জীবনঃ তিনি ১২৬৯ হিজরী সনে যশোর জেলায় কাজী পদে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মময় জীবনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে কাজী পদ হতে ইস্তফা দিয়ে  ১২৭০ হিজরী সনে তিনি কলিকাতা মাটিয়া বুরুজে মুন্সী বু আলী ছাহেবের মাদ্রাসায় অধ্যাপনার কাজ করেন। পরে ২বৎসর কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনায় নিয়োজিত থাকাকালীন থেকে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় সম্পৃক্ত করেন এবং পীরে তরিকতের নির্দেশক্রমে পরবর্তীতে স্বদেশে ফিরে এসে শরীয়ত- তরিকত- হাকীকত- মায়ারাফাত এর উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে খোদায়ী প্রেম সাধনায় আবিষ্ট থাকেন।

বায়াতগ্রহণ :১২৭১ হিজরীতে হযরত গাউসুল আযম আব্দুল কাদেরী জিলানী (ক.) এঁর বংশধর এবং উক্ত তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত হজরত শায়খ সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আলকাদেরী লাহোরী ছাহেব (র.) এঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে গাউছিয়তের ফয়েজ এবং পীরে তরিকতের নির্দেশক্রমে  (পীরে তরিকতে আপন বড় ভ্রাতা) হজরত শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (র.) হতে কুতুবিয়তের ফয়েজ হাছিল করেন।

বেলায়ত অর্জন: তিনি চারি প্রকারের বেলায়াত পদবীর অধিকারী মহান অলীয়ে কামেল ছিলেন। বিল আছালত-তিনি মাদারজাত বা জন্মগতভাবে বিল আছালত বেলায়ত প্রাপ্ত হন। বিল-বিরাসত- তিনি নিজ পীরে কামেল হজরত শায়খ সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আলকাদেরী লাহোরী ছাহেব (র.) এঁর খেদমত ছোহবত এবং খেলাফত হাছেলে বিল বেরাছত বেলায়ত প্রাপ্ত হন। বিদ-দারাছাতঃ- তিনি জাহেরী অর্থাৎ জাগতিক বিদ্যা অর্জন, বাতেনী অর্থাৎ রূহানী সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষা দ্বারা ফয়েজে এত্তেহাদী ও এলমে লদুন্নী হাছেল এর মাধ্যমে বেলায়ত বিদ দারাছত বেলায়ত প্রাপ্ত হন। বিল মালামত- তিনি মোখালেফাতে নফ্ছ বা প্রবৃত্তির বিরুদ্বাচরণে মোজাহেদা ও মোশাহেদার কঠোর সাধনার ফলে প্রাপ্ত হয়ে বেলায়তের চতুর্বিধ দরজার সর্বোচ্চ মকামের মালামিয়া মসরব বিশ্ব অলী সাব্যস্ত হন।

অধ্যাত্ম শরাফত : হযরত গাউসুল আযম মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) মঙ্গল ইচ্ছুক ও ত্রাণ কর্তৃত্ব সম্পন্ন ছায়েরে মায়াল্লার অধিকারী অধ্যাত্ম শরাফত সমৃদ্ধ গাউসুল আযম হন। তিনি খোদা প্রদত্ত গাউছুল  আজমীয়তের ক্ষমতায় জনগণের হাজত মকছুদ পূরণ করেন এবং তাঁর নিকট হতে ফয়েজ বরকত প্রাপ্ত হয়ে বহুজন অলী কুতুব আবদালে পরিগণিত হন এরূপ বহু ঘটনাবলী “গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর জীবনী ও কেরামত”নামক কিতাবে বর্ণিত আছে। তাঁর অধ্যাত্ম শরাফতের মহিমায় ফয়েজ প্রাপ্ত অলিয়ে কামেলদের মধ্যে নিজ ভ্রাতুস্পুত্রদ্বয় হযরত মওলানা শাহ্ ছুফী সৈয়দ আমিনুল হক ওয়াছেল মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছাহেব গাউছিয়ত ধারামতে ফয়েজপ্রাপ্ত “কুতুবে এরশাদ”এবং গাউসুল আযম বিল বেরাছত, হযরত মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ গোলাম রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.) প্রকাশ বাবা ভাণ্ডারী “কুতুবুল এবদাল” ধারামতে কুতুবুল আক্তাব মর্যাদায় বিকশিত হন।

তাঁর অধ্যাত্ম শরাফত সম্পর্কে বড় বড় আলেমগণের রচিত কিতাবাদি, গান গজল ইত্যাদির পর্যালোচনায় প্রমাণ মিলে। কলিকাতা নিবাসী শামসুল ওলামা মওলানা জুলফিকার আলী ছাহেব লিখেছেন : “গাউসে মাইজভাণ্ডারের নিঃশ্বাসের বরকতে পূর্বদেশবাসীরা আল্লাহ পন্থী ছাহেব হাল জজ্বার অধিকারী হন, অর্থাৎ দেহ ও প্রাণের সহিত খোদা প্রেম পরিব্যাপ্ত মানব প্রকৃতি জজ্বা হাল অবস্থা প্রাপ্ত হন। তাঁহার মাজারে পাকের বরকতে যে তাছির মাটিস্থ বুর্জুগানের এই দেশীয় কবরের মধ্যে জালালী ও উজ্জ্বলতা বা রওনক আনিয়াছে।”মোখালেফাতে নফ্স বা নফ্ছে ইনছানীর কুপ্রবৃত্তি ধ্বংস করে রূহে ইনছানীর সুপ্রবৃত্তি আনয়নের নিমিত্তে তার প্রবর্তিত মাইজভাণ্ডারী ত্বরীকায় সাধন কল্পে উছুলে ছাবয়া বা আত্মশুদ্বির সপ্ত পদ্ধতি আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

গাউসুল আজমিয়তঃ রসূলে করিম (দ.)এঁর দুইটি বেলায়তী তাজের যা মোহাম্মদী সম্মানের প্রতীক বেলায়তে মোকাইয়্যাদার কারুকার্য খচিত তাজ হযরত গাউসুল আযম শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (ক.) এঁর মাথা মোবারকে স্থাপিত যা তাঁর বাণী ওয়া তুয়াজজানি বিতাজানিল কামলি। (আমার মাথায় কারুকার্য্য খচিত বেলায়তি তাজ রয়েছে) দাবিতে স্পষ্ট।“আহমদী” সম্মান প্রতীক বেলায়তে মোত্লাকার কারুকার্য্য খচিত বেলায়তে ওজমার অধিকারী গাউছিয়ত ত্রাণ কর্তৃত্ব তাজ হজরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর মাথা মোবারকে স্থাপিত বলে উভয় বুজুগের্র দ্বারা ইহা স্বীকৃত। হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.) এঁর বাণীঃ- রসূলুল্লাহর (দ.) দুইটি টুপীর মধ্যে একটি আমার মাথায়, অপরটি আমার ভাই বড়পীর ছাহেবের মাথায় দিয়াছেন।” “আমার নাম পীরানেপীর ছাহেবের নামের সাথে সোনালী অক্ষরে লিখা আছে।” এই কালামগুলো তাঁহার গাউসে আজমীয়তের প্রমাণ ও স্বীকৃতি।

প্রবর্তিত দর্শনঃ হযরত গাউসুল আযম আব্দুল কাদের জিলানীর (ক.) ওফাতের প্রায় ৫০০ বছর পরে মানবজাতিকে সুপথে আনার হযরত গাউসুল আযম মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর শুভ আবির্ভাব ঘটে এভবে। তিনি বললেন আল্লাহ্ এক, সকল ধর্মের মূল কথা এক, পৃথিবীর সকল মানুষ ও সবকিছু আল্লাহ্র সৃষ্টি। তিনি সবাইকে আল্লাহ্র একাত্মবাদের দিকে বেলায়তের মোত্লাকার পদ্ধতিতে আহ্বান করেছেন। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্মিশেষে সকল মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেওয়া-এ-আহমদী পতাকা তলে সমবেত হতে থাকে। সকল মানুষ খোদায়ী প্রেমসুধা প্রাণ করে স্রষ্টামুখী হয়। তিনি তাঁর দর্শনের মাধ্যমে ধর্মসমূহের নীতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠাকল্পে কালজয়ী ভূমিকা পালন করেন। ফলশ্রুতিতে এতদিন ধরে যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও হানাহানি করত তারা এবং যারা ধর্মহীন তারাও মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকা ও দর্শনের প্রতি মুগ্ধ হয়ে আল্লাহ্র একাত্মবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত। সৎ পথে চলতে, সৎ কর্ম করতে যথা মানবতার কল্যাণে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে সচেষ্ট হতে থাকে। মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকা সকল মানুষের প্রতি তাওহীদে আহ্বান জনিত দর্শন হওয়ায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টাব, উপজাতি তথা সকল ধর্মাবলাম্বীর মনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি মাওলানা হাফেজ ক্বারী মুফতি, মোহাদ্দেস, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশার লোকজন এই দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্রষ্টামুখী হতে থাকে। মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকা ও দর্শন নতুন কোন ধর্মমত নয়, এ ত্বরিকা ও দর্শন পূর্ববর্তী ত্বরিকাগুলোর মতো পবিত্র কোরআন হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত ও সুফিবাদের যুগোপযোগী সংস্করণ। হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসী প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মকে একটি কেন্দ্রে আনার জন্য যুগান্তকারী বলিষ্ট পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। মাইজভাণ্ডারীয়া দর্শনের মূল নীতিসমূহ নিম্নরূপ: তিনি ৭টি নীতি প্রয়োগ করলেন যা দুই ভাগে বিভক্ত।

১.            ফানায়ে সালাসা

(ক) ফানা আনিল খালক

(খ) ফানা আনিল হাওয়া

(গ) ফানা আনিল এরাদা

২. মাওতে আরবায়া

(ক) মাউতে আবইয়্যায

(খ) মাউতে আসওয়াদ

(গ) মাউতে আহমর

(ঘ) মাউতে আখযার

 

বিষদ বর্ণনা : ফানায়ে সালাসা

(ক) ফানা আনিল খালক : কারো নিকট কোনরূপ উপকারের আশা বা কামনা না থাকা। যা সৃষ্টি অনুরাগী মানবকে স্রষ্টা অনুরাগী করে। ফরে শিরক দূর হয়। যা ধর্মের প্রধান কাজ। ঈমান।

(খ) ফানা আনিলহাওয়া : যা না হলেও চলে সেই রূপ কথা কাজ আচরণ হতে বিরত থাকা। যা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ হতে বাঁচিয়ে রাখে। যা ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যে। ফলে মানব স্রষ্টার বান্দাতে গণ্য হয়। অন্যতায় শয়তানের বান্দা থাকে। কারণ বন্দেগীকারীকে বান্দা বলে। বন্দেগী অর্থ আনুগত্যতা।

(গ) ফানা আনিল এরাদা : নিজ ইচ্ছা ছেড়ে স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিচালিত হওয়া। যা নবী ও আউলিয়াগণের রীতি। যা হাসিল না হলে মানব স্রষ্টানুগত নয়। এই তৃতীয় স্তরে উপনিত হলেই মানব আল্লাহ্র বান্দা হিসেবে গণ্য হয়। এই স্তরে উপনিত হওয়া কঠিন কাজ। কিছু প্রচেষ্টা অবশ্যই করতে হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর মাত্র এরই প্রমাণ যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী মানব নিকৃষ্ট সৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় প্রথা হতে উঠে সর্ব সৃষ্টির সমান গুণ হাসিল করা এবং তৃতীয় স্তরে এসে বন্দা হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব হাসিলের জন্য স্থিরতা লাভ করা। এখন স্রষ্টার মূল লক্ষ্য প্রতিনিধিত্ব। যা পবিত্র কোরআনে নির্দেশিত।

*             নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টিকারী  (২:৩)

*             তিনি পৃথিবীতে তোমাদের প্রতিনিধি করেছেন  (৩৫:৩৯)

* তিনিই তোমাদিগকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং একজনকে অন্যজনের উপর মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। যা তোমাদের দান করা হয়েছে তার পরীক্ষা স্বরূপ (৬:১৬৫)। উল্লিখিত আয়াত পর্বে জানা যায় আল্লাহ্র অর্পিত হারিয়ে ফেলা এই প্রতিনিধিত্ব গুণ মানবকে পূর্ণ হাসিল করতে হবে। যা নর-নারী প্রত্যেকের উপর অপরিহার্য।

* এই জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নানীর উপর ফরজ (ইবনে মাযা : ২২৪, বায়হাক্কী : ১৫৪৪)

মাওলানা আলী বলেন

*ইহা এমন একটি জ্ঞান যা নবী বা নবীর অসি ছাড়া কেউ জানে না। (দেওয়ানে আলী ৫ পৃষ্ঠা)

আল্লাহ্র ইচ্ছাও তাই। নবীর পরবর্তী যুগে বেলায়তে উজমার অধিকারী গাউসুল আযমের অসি হিসেবে শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) থেকে আমরা জানতে পারি।

পূর্বে বর্ণিত ত্রিবিধ ফানা হারিয়ে ফেলা যোগ্যতা অর্জন করিয়ে দেয়। আর প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা অর্জনের জন্য যে পরীক্ষার কথা পূর্ববর্তী আয়াতে অর্থাৎ

*             যা তোমাদের দান করা হয়েছে তা পরীক্ষাস্বরূপ (৩৫:৩৯)

*             মানুষ কি মনে করে যে, আমরা বিশ্বাস করি, এ কথা বললে তাদের পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেওয়া হবে? (২৯:২)

তা হুসুলে মোখালেফাতে নফস বা ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করে নিজ আত্মাকে বশীভূত করে খোদায়ী শক্তি অর্জনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের গুণ হাসিলের পরীক্ষার জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। যা নিম্নোক্ত চার প্রকার নিজ ইচ্ছার মৃত্যুতে অর্জিত হয় সহজেই।

(ক) মাউতে আবইয়্যায (সাদা মৃত্যু) : সংযম, উপবাস যাপন, কম নিদ্রা, কম আহার। ফল : যার ফলে মানব মনে আলো বা উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। যেমন : রোযা।

(খ) মাউতে আসওয়াদ (কালো মৃত্যু) : শত্রুর নিন্দা ও সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ করা। প্রতিহিংসা ও ক্ষোভ দমন। ফল : শত্রুর সমালোচনার পর মানব যখন নিজের মধ্যে উল্লেখিত সমালোচনা বা নিন্দার কারণ খুঁজে পেলে পরিত্যাগের সুযোগ হয় ও আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনার উপায় হয়। আর যদি দোষারোপকারীর দোষ নিজের মধ্যে না থাকে তবে নিজেকে দোষমুক্ত বলে স্থির করতে পারে ও আল্লাহ্র শোকর আদায়ের সুযোগ হয়। ফলে সমালোচনাকারীকে উপকারী বন্ধু মনে হয়।

(গ) মাউতে আহমর (লাল মৃত্যু) : লোভ, লালসা, যৌন দৃষ্টি বা কামভাব দমন ও সংযত করুন। ফল : যার ফলে আল্লাহ্র মকবুল বান্দা ও নবী-অলিদের মধ্যে গণ্য হয়।

(ঘ) মাউতে আখযার (সবুজ মৃত্যু) : নির্বিলাস জীবন-যাপনের অভ্যস্থ হওয়া। ফল : যার ফলে মানব মনে স্রষ্টা প্রেম ছাড়া কিছু থাকে না। যা হযরত খিযির (আ.) এর স্বভাব বা স্থায়ী জিন্দেগী বা অমরত্ব হাসিল হয়।

এই সপ্ত প্রকার মুক্তি পদ্ধতি যেহেতু নেহায়ত ঝামেলা মুক্ত, উৎসাহমূলক, আনন্দদায়ক, হিংসা বিহীন এবং উভয় জগতের উন্নয়মূলক নীতি, দেশ ও জাতি, সাদা-কালো, সংসারী ও অসংসারী সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য ও সহজসাধ্য বিধি ব্যবস্থা এই পথচারী সঙ্গে সঙ্গে ফলাফর বুঝতে ও উপভোগ করতে সমর্থ এবং সার্বজনীন যুগ উপযোগী ব্যবস্থা রীতি-নীতি। আসুন আমরা এই সুফিবাদী নীতি অনুসরণে মান হিসেবে জন্মকে সফল করি।

ওফাত : মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ এর মূল স্থপতি হযরত গাউসুল আযম মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহমাইজভাণ্ডারী (ক.) সাহেব তাঁর অধ্যাত্ম শরাফতের মহিমায় বিশ্বমানবতার অভূতপূর্ব কল্যাণ সাধন এবং অনাবিল করুণা বর্ষণ করে ১৯০৬ ইং, ১০ মাঘ ওফাত লাভ করেন। প্রতি বছর মহান ১০ মাঘ, ২৪ জানুয়ারি এই মহান অলিয়ে কামেল এঁর পবিত্র ওরশ শরিফ অনুষ্ঠিত হয়।

কারামত : সংক্ষেপে কারামত সমূহ

১.            হযরতের প্রভাবে বিপরীত দ্রব্যে রোগ মুক্তি।

২.           হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে মোহসেনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত।

৩.           কশ্ফ ক্ষমতায় হাটহাজারী মাদ্রাসার স্থান নির্ধারণ।

৪.           আহমদিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদের স্থান নির্দেশ ও পত্তন।

৫.           সাগর ডুবি হতে সামগ্রীসহ ভক্ত উদ্ধার।

৬.           আনার প্রদানে আশ্চর্য কারামত ও ফয়েজ দান।

৭.           মসজিদে হযরতকে নূরানী জ্যোতির্ময় দেখা।

৮.           স্বপ্নযোগে হযরতের বেলায়তের পরিচয়।

৯.           মাজহারী মাহফিলে হযরতের অদ্ভূত উপস্থিতি।

১০.         ওফাতের পর হযরতের প্রত্যক্ষ দর্শন দান।

অসংখ্য কারামতাদি বিভিন্ন কিতাবে দ্রষ্টব্য। যেমন ‘জীবনী শরিফ’, গোল্ড মেডেলিস্ট ফয়েজ উল্লাহ্ ভূঁইয়া (সীতাকুণ্ড), ‘আয়নালে বারি’তাঁর খলিফা আল্লামা আব্দুল গণি কাঞ্চনপুরী রচিত। ‘তোহ্ফাতুল আখইয়ার’তাঁর খলিফা আল্লামা আমিনুল হক ফরহাদাবাদি রচিত। বাংলাদেশের পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের রচিত মুর্শিদা গান গ্রন্থেও এ সকল কারামতের বর্ণনা পাওয়া যায়।

 

মাওলানা এস এম এম সেলিম উল্লাহ্

মাওলানা এস এম এম সেলিম উল্লাহ্

লেখক- মাইজভাণ্ডারী গবেষক

 

Comments (0)
Add Comment