দিনের শেষাংশের সূর্যের মতোই যেন অস্ত গেলো দেশীয় ফুটবল। এখন গ্রামের তরুণ কিশোররা তেমন খেলাধুলা করেই না। অধিকাংশ সময় কাটে মোবাইল, কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে নানান গেইম খেলায়। আর তরুণদের যেই একটা অংশ এসবের বাইরে এসে মাঠে ক্রিকেট বলেন বা অন্য খেলাধুলা যাই করে তাদের সংখ্যাটা খুব নগন্য। এটা গ্রাম বা শহরের পরিসংখ্যান মিলালে সহজেই অনুমেয় হবে।
তো, বলছিলাম দেশীয় ফুটবলের কথা। আমাদের দেশের ফুটবল খেলাটা ঐতিহ্য হারিয়ে কেমন যেন নিরামিষ হয়ে আছে। ফুটবলের তেমন আমেজ নেই। নেই কোন ফুটবলের জমজমাট কোন আসর। যা হয় তা বছর ছ’মাসে দু-একটা। অথচ এর বিপরীতে ক্রিকেটে কোন উপলক্ষ্য লাগে না ছেলেপেলেরা হরহামেশাই ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত।
বর্তমানে তো ক্রিটেও শর্টপিচ নামে দারুণ আসর জমে গঞ্জে বা শহরে। প্রায় সময় দেখা যায় এই ক্রিকেট নিয়ে রাত্রিকালীন আসরও জমে উঠে। এই অবস্থা এমন যে, যেন দেশীয় খেলার জগতে ক্রিকেটেই সব আমেজ। অথচ একটা সময় দেশের ফুটবল উন্মাদনা ছিলো চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন স্রোতের প্রতিকূলে চলছে বাংলাদেশের ফুটবল খেলা। ফুটবল খেলার অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কোন অবিভাবক নেই। যদি এর বিপরীতে তাকাই তাহলে দেখা যায় ক্রিকেটেই বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছে। তা তারা যতোখানি রাখতে পেরেছে।
দেশের ফুটবল স্বাধীনতার আগে থেকেই মাঠে গড়িয়েছে। সেই স্বাধীনতার পরেই তো দেশীয় ফুটবলের কতো কতো ইতিহাস আর নাটকীয়তা। কিন্তু এই দেশীয় ফুটবলে দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেলেও উঠে আসেনি কোন নামীদামী খেলোয়াড়। দেশের ফুটবলের উন্নয়নে নজর না দিয়ে বাঙালিরা মেতে আছে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন দলের তারকা অথবা বিশ্বে চমক লাগানো প্লেয়ার মেসি-রোনালদো আর সালাহকে নিয়ে।
পেছনে ফিরে তাকালেই দেখা যাবে আমাদের দেশীয় ফুটবলের আছে এক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। ছিলো ইতিহাস সেরা আব্দুস সামাদ, আশীষ ভদ্র, আশরাফ আলী চুন্নু, আসলামের মতো খেলোয়াড়। এই ক্ষণজন্মা বাংলাদেশী ফুটবলার বিশ্ব ফুটবলকে মাতিয়েছে দারুণ নৈপুণ্যে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট তার উল্টো গতিতে চলছে। তাদের ঐতিহ্য দেশের ফুটবল আর ধরে রাখতে পরেনি। ধীরে ধীরে হারিয়েছে দেশীয় ফুটবলের উন্মাদনা।
বর্তমানে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল দল। দলে এখন সম্ভাবনাময় অনেক খেলোয়াড় জায়গা করে নিয়েছে। তারুণ্য নির্ভর জামাল ভূঁইয়াদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন ইংরেজ ফুটবলার কোচ জেমি ডে। কিন্তু এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে পাড়ি দিতে হবে আরো বহুদূর। জাতীয় পর্যায়ে তরুণ খেলোয়াড়দের সার্বক্ষনিক তত্বাবধানে রেখেই গড়ে তুলতে হবে আগামী দিনের জন্য। অন্যথায় এই ব্যর্থতার ভরাডুবিতেই থাকতে হবে।
এই যে দেশব্যাপী নানান উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ফুটবল একাডেমি গড়ে উঠছে এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের রেফারিজ এসোসিয়েশনের সদস্য আব্দুল হান্নান মিরণ, সাবেক ফুটবলার সামছু উদ্দিন চৌধুরী ও হায়দার কবির প্রিন্সের দক্ষ পরিচালনায় চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম পাড়ায় গড়ে তুলেছে চট্টগ্রাম ফুটবল ট্রেইনিং একাডেমি নামের প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রামে এই উদীয়মান ও তরুণ প্রজন্মের ফুটবলারদের জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ফুটবল ট্রেইনিং একাডেমির কর্মকর্তা এবং কোচ আব্দুস শুক্কুর রানা ও ইকরাম আফসার। চট্টগ্রাম ফুটবল ট্রেইনিং একাডেমির দায়িত্ব প্রাপ্তদের সাথে দেশ ও চট্টগ্রামের ফুটবল অবস্থা জনতে চাইলে তারা জানান, তারুণ্য দীপ্ত এই খেলোয়াড়দের তুলে আনার নানান পরিকল্পনার কথা। একই সাথে এখান থেকেই আলাদা আলাদা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তুলে আনবে যাদুকরী ফুটবল খেলোয়াড়।
তো দেশে এতো এতো ফুটবল একাডেমি গড়ে উঠাতে আশা করছি দেশের ফুটবল আবারো তার হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে পারবে। সেই সাথে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নজর দিবে দেশের গৌরব ফিরিয়ে আনতে। জোরালো ভূমিকা রাখবে দেশের ফুটবল খেলাকে সমানতালে তুলে আনতে। এদের দক্ষ প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় উঠে আসবে আগামী দিনের আবদুস সামাদ, কাজী সালাউদ্দিন, বাদল রায়, কায়সার হামিদ, সাঈদ হাসান কাননের মতো সেরা ফুটবলার। অথবা নতুন দিনের যাদুকরী ফুটবল বিষ্ময়। তবেই দেশের ফুটবল জগত আবারো হেসে উঠবে আপন আলোয়। বিশ্ব ফুটবলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ।
লেখক-মিজান ফারাবী, কবি ও প্রাবন্ধিক।