অনলাইন ডেস্ক :
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অচলাবস্থা । চট্টগ্রামে ১৯টি আইসিডিতে ৫৩ হাজারের বেশি কনটেইনার আটকে আছে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ হাজারই রপ্তানিমুখী পোশাকের কনটেইনার। চীন, সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনার জটের কারণে এ সমস্যা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। এতে বাড়ছে রপ্তানির খরচ। দীর্ঘমেয়াদি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অর্ডার কমে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করে, তারা বৈশ্বিক সমস্যার শিকার। তাদের তেমন কিছু করার নেই। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বেসরকারি আইসিডি মালিক, ফ্রেট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন, শিপ ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্টরা আজ মঙ্গলবার ঢাকায় জরুরি বৈঠকে বসছেন।
বাংলাদেশ থেকে বছরে চার হাজার কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। এই শিল্পের ওপর দেশের ৪০ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি নির্ভরশীল।
রপ্তানিকারকসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্বের অন্যতম শিপিং জায়ান্ট জার্মানির প্রতিষ্ঠান হেপ লয়েড এরই মধ্যে জানিয়েছে, তারা আগামী চার সপ্তাহ বাংলাদেশগামী পণ্য পরিবহন করবে না। শুধু হেপ লয়েডই নয়, বিশ্বের শীর্ষ কনটেইনার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন বাংলাদেশে আসতে চাইছে না। তারা করোনা–পরবর্তী বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি ফেরায় চীন, ইউরোপ ও আমেরিকায় পণ্য পৌঁছানোকে বেশি লাভজনক মনে করছে। হেপ লয়েড বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে ২০ ফুট আকারের অন্তত ৯ হাজার কনটেইনারে আমদানি পণ্য পরিবহন করে। প্রায় একই পরিমাণ কনটেইনারে রপ্তানি পণ্যও পরিবহন করে থাকে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশের ১৯টি ডিপোতে গতকাল পর্যন্ত মোট ৫৩ হাজারের বেশি পণ্যবাহী কনটেইনারের জট তৈরি হয়েছে। জাহাজ না পাওয়ায় এসব কনটেইনার জমা হয়েছে। কবে এগুলো জাহাজে তুলে দেওয়া যাবে, এ তথ্য কেউ দিতে পারছে না।
এ ব্যাপারে বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়ুম খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। জাহাজ আসছে না। বিভিন্ন বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে আছে। কনটেইনার–সংকট বাড়ছে। আমাদের ডিপোগুলোয় পণ্যবাহী কনটেইনার উপচে পড়ছে। এতে সংশ্লিষ্টদের খরচের বোঝা বাড়ছে।’
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ জাফর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, একটি সমস্যা হয়েছে। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের বন্দরের এতে কিছুই করার নেই। রপ্তানিকারকেরা ৪০ ফুট কনটেইনারে পণ্য পাঠানোর চুক্তি করেছিলেন বিভিন্ন শিপিং এজেন্টদের সঙ্গে। বৈশ্বিক চাহিদার কারণে সেসব কনটেইনার এখন ইউরোপ-আমেরিকায় আটকা পড়েছে। যে কারণে ওই সব কনটেইনারের সংকট। তারা যদি ক্রেতাদের স্বার্থ আর ভবিষ্যৎ আদেশের কথা ভেবে তাদের পণ্যগুলো ২০ ফুট কনটেইনারে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়, তবে সাময়িকভাবে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। এখানে সরকারের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। সরকার তাদের চাহিদামতো সরাসরি জাহাজ কোথা থেকে দেবে?’
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আসলে এই সমস্যা আমাদের নয়। আমরা আমাদের স্বাভাবিক কাজ করছি। যাদের সমস্যা, এটা তারা দেখবে। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। তবে এখানে আমদানি পণ্যের খালাস কম হচ্ছে, এটা ঠিক। এটা মূলত লকডাউনের কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পণ্য ছাড়িয়ে নিয়ে কী করবে? স্বাভাবিকভাবেই পণ্য খালাস কম।’
এ ব্যাপারে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সাধারণত আমদানি পণ্যবাহী জাহাজেই রপ্তানি পণ্য পাঠানো হয়। যেহেতু করোনার কারণে আমদানি কমে গেছে, তাই পণ্যবাহী জাহাজ কমে গেছে। তা ছাড়া, সিঙ্গাপুর, চীন, কলম্বো বন্দরেও জাহাজজট লেগেছে। এর ধাক্কাই লেগেছে এখানে। সমস্যা প্রকট হচ্ছে। চার্জ বেড়ে যাচ্ছে। এখন যদি ক্রেতারা পণ্যগুলো বিমানে পাঠাতে বলে, তাহলে আমরা মুশকিলে পড়ে যাব। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। অনেক বেশি মাশুল গুনতে হবে।’
নিট পোশাক রপ্তানিকারক ও বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি। কনটেইনার ও জাহাজসংকটে বাংলাদেশ থেকে যথাসময়ে রপ্তানিযোগ্য পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। সিঙ্গাপুরেও জাহাজজট চলছে। এর মধ্যে শিপিং কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের দিকে জাহাজ না পাঠানোর ঘোষণা দিচ্ছে। এতে লিড টাইম বেড়ে যাচ্ছে। ৪৫ দিনের সময়সীমা ১০ থেকে ১৫ দিন বেড়ে ৬০ দিনে গিয়ে ঠেকছে। চীন ও ভিয়েতনাম থেকে সরাসরি রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজ গন্তব্যে যাচ্ছে। আমরা পাঠাতে পারছি না। এখানে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। সব মিলিয়ে একটি কঠিন সময় পার করছে রপ্তানি খাত। আমাদের অর্ডার আছে। কিন্তু একটি গ্লোবাল সমস্যার কারণে আমরা পণ্য সময়মতো পাঠাতে পারছি না।’
ওভেন ও নিট পোশাক রপ্তানিকারকেরা জানান, ইউরোপ–আমেরিকায় টিকা দেওয়ার কারণে ওই সব দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এরই মধ্যে ওই সব দেশের দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। মানুষের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে; বিশেষ করে কম দামি পোশাক, যা বাংলাদেশ সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশে কয়েক মাস ধরে বিপুল অর্ডার আসছে। রপ্তানিকারকেরা অনেকে কাজ করে শেষ করতে পারছেন না। পুরো পোশাক খাত ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ পেয়েছে। অথচ পণ্য পরিবহনের বৈশ্বিক এ সংকটের কারণে এখন রপ্তানি অনেকাংশে হুমকির মুখে রয়েছে। এই সংকটের কারণে কিছু কিছু শিপিং কোম্পানি ৪০ ফুটের একটি কনটেইনারের ভাড়া ১৯ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবি করছে। অথচ করোনার আগে এ রকম একটি কনটেইনারের ভাড়া ছিল ২ হাজার ২০০ ডলার।
এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ জরুরি বৈঠক ডেকেছে। আজ গুলশানে বিজিএমইএর লিয়াজোঁ অফিসে এ বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।