কেবল নেটওয়ার্কের চ্যানেলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতেন তিনি। বিজ্ঞাপন দেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যা সমাধানের নামে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের এক ভুক্তভোগীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জিনের বাদশা পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তিসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বুধবার (৪ আগস্ট) দুপুরে মালিবাগে সিআইডির সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুক্তা ধর।
ভোলার বোরহানউদ্দিনে সর্বত্র ছেয়ে গেছে ‘জিনের সাধক’ নামক একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ ব্যবসার সাথে প্রতিদিনই নতুনভাবে জড়িয়ে পড়ছে যুব সমাজ। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এতে অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হলে নিরব ভূমিকা পালন করছে স্থানীয় প্রশাসন।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকায় ৪-৫ বছর আগে কথিত জিনের সাধকদের আগমন ঘটে। জিনের সাধক শেখ সাদি হাওলাদার প্রথম জিনের ব্যবসা করেন। এরপর তার শিষ্য পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এদের প্রথম লক্ষ্য প্রবাসী পরিবার ও ধনাঢ্য পরিবার। তারা প্রথমে ওই পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করে, পরে শুরু হয় প্রতারণার কার্যক্রম।
চক্রটি গভীর রাতে নিজের কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে ফোন করে নিজেকে বড় আল্লাওয়ালা, জিন, বড়পীর পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করেন। ধার্মীকদের বিষয়ে মুসলমানরা একটু দুর্বল থাকেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের বড় পীর দাবি করে ভাগ্য খুলে যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। প্রমাণ হিসেবে আগের সংগ্রহ করা তথ্য, পরিবারের গোপন বিষয়গুলো বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।
ভুক্তভোগীরা ভাবেন- সে যদি বড় পীর না হয়, আমার পরিবার ও পরিবারের সমস্যার কথা কিভাবে সে জানেন! বিষয়টিকে সত্য বলে ধরে নেয় তখন তাদের বিভিন্ন বিপদ আপদের ভয় এবং কোটিপতি হওয়ার লোভ দেখায় চক্রটি। যখন তারা লোভাতুর হয়ে পরে তখন জানতে চায় কীভাবে তাদের ভাগ্য ফিরবে।
তখন তারা হাদিয়ার কথা বলে কৌশলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। আর যারা এ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান তাদের পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতির ভয় দেখান ওই জিনের সাধকরা। তাদের কথা না মানলে সব চেয়ে আদরের শিশু সন্তানের মৃত্যু এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে বলে ভয়ও দেখান। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ টাকা দিতে বাধ্য হন।
এ ধরনের প্রতারণা করে রাতারাতি লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকেই। আর এদের দেখা দেখি অনেক যুব সমাজ এ প্রতারণা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। কুঞ্জের হাট বাজার, মিঝির দোকান, ঘোলপাড় এলাকাসহ পুরো উপজেলায় এ চক্রটি ছড়িয়ে পড়ছে। এমন লোকজন এ প্রতারণা ব্যবসা করছে তাদের চেহারা দেখে বুঝার কোন উপায় নেই।
এদিকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা প্রতারক চক্ররটির পকেটে চলে যাচ্ছে। সচেতন মহলেও দাবি এদের হাত থেকে কোন দিনই যেন সহজ সরল লোকজন মুক্তি পাবে না। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও কোন সুফল পাচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্তরা। কারণ ওই চক্রটি মোটা অংকের অর্থ দিয়ে প্রশাসনকে চুপ করিয়ে রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া পুলিশ ও ডিবি মাঝে মধ্যে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও তার সুফল মেলে না। কারণ তাদের আটকের পর শুরু হয় দরকষাকষি। অনেকেই টাকা দিয়ে ছুটে যান। ফলে প্রতারক চক্রগুলোকে র্নিমূল করার সম্ভব হচ্ছে না।
ওই এলাকার আ. রহমান ও মো. কামাল ও নুরনবী জানান, আমাদের এলাকা এদের কারণে অতিষ্ট। এরা মাদকের সাথেও জড়িয়ে পড়েছে। মানুষের সাথে কীভাবে প্রতারণা করে দিনমজুর হতে আজ লাখপতি হয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখা দেখি অনেক যুবক এ প্রতারণা সাথে জড়াচ্ছে। তাই দ্রুত এদের নির্মূল করতে না পারলে আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে।
কাচিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে’র ইউপি সদস্য মো. নিজাম সিকদার আমাদের সময়কে বলেন, অন্য এলাকায় গিয়ে কাচিয়া ইউনিয়ন পরিচয় দিলে তারা আমাদেরকে জিনের এলাকা বলে মশকারা করে। এতে আমরা খুবই বিব্রত হই। বর্তমানে এ প্রতারক চক্রটি সক্রিয়ভাবে এ প্রতারণা করে যাচ্ছে। তাই প্রশাসনের কাছে এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জোরালে দাবী জানাচ্ছি।
কাচিয়া ইউনিয়ন ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আ. রব কাজী আমাদের সময় কে বলেন, আমরা চক্রটিকে নির্মূলে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি এবং প্রশাসনকেও সহযোগিতা করছি। কিন্তু কিছু অর্থলোভীদের কারণে এদের নির্মূল করার সম্ভব হচ্ছে না। তারা তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা খাচ্ছে।
বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমিন তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, জিন প্রতারণার সাথে যারাই জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু ওরা নামে বেনামে সিম কার্ড দিয়ে এ প্রতারণাগুলো করে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।