আল্লাহর সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে সম্মানিত ও মূল্যবান সৃষ্টি মানুষ। এই মানুষের ভেতরে আছে সবচেয়ে মূল্যবান ও সংবেদনশীল মন। আর মানুষের অন্তরের অমূল্য রত্নের নাম ভালোবাসা। পৃথিবীতে যদি ভালোবাসা না থাকে, তবে সবুজ পৃথিবী খড়কুটোয় পরিণত হবে।
মানবহৃদয়ের ভালোবাসা এত তীব্রও হয় যে ভালোবাসার মানুষকে এক মুহূর্তের জন্য আড়াল করতে চায় না এবং একজন মানুষের জন্য পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিমুখ হয়ে যায়। একজনকে সন্তুষ্ট করতে পৃথিবীর সব মানুষকে অসন্তুষ্ট করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তবে মানুষ ভালোবাসার মূল্যে শুধু একটি জিনিসই কিনতে পারে এবং একবারই ‘দিলের সওদা’ করতে পারে। সে সবার সঙ্গে থেকেও কারো সঙ্গে না-ও থাকতে পারে এবং সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও সম্পর্কহীন হতে পারে। সে জেল ও জিঞ্জিরে থেকেও মুক্ত থাকতে পারে এবং সতর্ক ও সচেতন অবস্থার মধ্যেও আত্মভোলা হতে পারে। পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের সে উপেক্ষা করতে পারে আবার পথের ফকিরের পায়ে পড়ে যেতে পারে। তার কাছে শেষ রাতের আহাজারি এবং আকুল প্রার্থনা হাজারো রাজত্ব ও রাজমুকুটের চেয়ে উত্তম মনে হয়। আর এই অনুভব অন্তরে তখনই আসে যখন অন্তর সব কিছু থেকে শূন্য হয়। কোনো আনন্দ বা বেদনা, কোনো আশা বা হতাশা তাকে প্রভাবিত করে না। সে শুধু দেখে অন্তরের আলোকদীপ্ত স্থানটি তাঁর জন্য শূন্য কি না, মনের সিংহাসন তাঁর জন্য খালি কি না। কবি বলেন, ‘আমার কাছে আমার প্রিয়তম এসেছে আমি তাকে চেনার আগে। সে আমার অন্তরে শূন্য পেল এবং সেখানে জায়গা করে নিল। ’ অর্থাৎ তিনি যখন আসেন, তখন অন্তরের দরজা সব কিছুর জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং গাইরুল্লাহর প্রবঞ্চনা ও ধারণা সেই দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। যদি কখনো সেখানে পৌঁছার চেষ্টা করে তবে তার পরিণতি হয়—‘তার পশ্চাদ্ধাবন করে প্রদীপ্ত শিখা’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ১৮)
আর মুমিনের পরিণতি হয়—‘তাদের শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তত্ক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২০১)
আমাদের জন্য এই আত্মমর্যাদাপূর্ণ ভালোবাসার বার্তা হলো—‘নিজের প্রবৃত্তিকে পেছনে ফেলে আমার দিকে অগ্রসর হও। ’ প্রথমে নিজের দৃষ্টিশক্তি ও অভিজ্ঞতা থেকে এটা দেখো যে, তুমি তোমার মূল্যবান অন্তরে কত অশুচি পশুত্ব এবং ভয়াবহ বিষ ধারণ করছ, তুমি নিজের কতটা আমিত্ব ও ভুলত্রুটিগুলো অন্তরে পুষে রেখেছ, অপবিত্রতার এমন কোন প্রকার আছে, যা তোমার অন্তরে নেই? পাপাচার ও গাইরুল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কোন আবর্জনা থেকে তুমি নিজের অন্তরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পেরেছ? তুমি তোমার অন্তরে স্বর্ণ-রৌপ্য এবং মণি-মাণিক্যের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছ এবং তাঁর সামনে নিজের মাথাকে মাটিতে রেখেছ, কিন্তু তোমার অন্তর অন্য কিছুর সিজদা করে। কবি বলেন, ‘যখন আমি সিজদা করি, জমিন থেকে আওয়াজ আসে—তোমার অন্তর প্রবৃত্তির পূজায় লিপ্ত, এই নামাজ থেকে তুমি কি পাবে?’ বাহ্যত তুমি আল্লাহর সামনে হাত বেঁধে রেখেছ, কিন্তু তোমার কল্পনায় ভিন্ন কিছু আঁকছ। মসজিদে বিছানো চাটাই দেখে তুমি ইরানি কার্পেট ও আরামদায়ক সোফার চিন্তায় মত্ত।
তুমি নিজের ক্ষমতা ও খ্যাতির জন্য কত মানুষের অধিকার নষ্ট করেছ। কত নিরাপরাধ মানুষকে তোমার পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছ। নিজেকে কতভাবে প্রতারিত করেছ এবং নিজের ভাইকে কত দিন ধোঁকায় ফেলে রেখেছ। তুমি নিজের ভুল ধারণাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছ এবং চোখ বন্ধ করে তার পেছনে ছুটেছ। এমনকি তা তোমাকে এমন দুর্গম স্থানে এনে ছেড়ে দিয়েছে, যেখান থেকে ফেরার পথ তোমার জানা নেই এবং কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী পথপ্রদর্শকও তোমার নেই।
তুমি মন ও চোখের গোপন পথে অন্তরে কত পাপ একত্র করেছ এবং চোখের নাপাকি দ্বারা অন্তরকে দূষিত করেছ খুশি মনে। তুমি তোমার অন্তরকে চিড়িয়াখানায় পরিণত করেছো। তার ভেতর বিভিন্ন প্রজাতির পশু পালন করছ। এই পশুগুলোই তোমার চরিত্র ও কাজের জীবন্ত রূপ। তোমার লোভ কুকুরের, তোমার চিন্তাধারা শূকরের, তোমার অবিচার বাঘের, অন্যকে কষ্ট দেওয়ার তোমার ইচ্ছা সাপের রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ পশু ও কীটপতঙ্গের কোনো আকৃতি ও সাদৃশ্য তুমি নিজের মনের চিড়িয়াখানায় স্থান দাওনি এবং প্রতিপালন করছ না। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত এর বিপরীত। আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজের মনের কাবাকে সব ধরনের ‘মূর্তি’ থেকে পবিত্র করতে হবে, মনের ওপর পাথর রাখতে হবে, কখনো কখনো পেটে পাথর বাঁধতে হবে, প্রবৃত্তির গলায় ছুরি চালাতে হবে, কদমে কদমে নিজের বিরোধিতা করতে হবে, তার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করার শক্তি অর্জন করতে হবে, হাসিমুখে বা অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের প্রিয় জিনিস বিসর্জন দিতে হবে—যা ছিল সারা জীবনের সঙ্গী।
যদি আমাদের সত্যিই ভালোবাসা লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে তা অর্জনের পথ এটাই। আল্লাহর ভালোবাসায় ব্যাকুল হৃদয়ে গাইরুল্লাহর কোনো স্থান নেই। ভালোবাসার প্রথম পরীক্ষা হলো—“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদের পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেওয়া হবে? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী এবং তিনি অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা মিথ্যাবাদী। ” (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ২-৩)