প্লাস্টিকের ডিম কিংবা প্লাস্টিকের চালের কথা বহুবার শোনা গেলেও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার প্রমাণ নেই। তবে এবার নিত্যদিনের ভোগ্য পণ্য চিনিতে প্লাস্টিক থাকার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকেরা। তাও একেবারে নামিদামি ব্র্যান্ডের চিনিতেই মিলেছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি।
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এ গবেষণায় সহযোগিতা করেন অধ্যাপক খবির উদ্দিন, স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন ও নয়ন হোসেন খান এবং ব্রাজিলের গোইয়ানিয়া ফেডারেল ইন্সটিটিউটের গবেষক মালাফ্যায়া গুলহাম।
গবেষণাটি ইতিমধ্যেই সায়েন্স জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ এর অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রিন্ট ভার্সনে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয় বাংলাদেশের সুপারশপ থেকে সংগ্রহ করা পাঁচটি ব্র্যান্ডের এবং দু’টি খোলা চিনির নমুনা পরীক্ষা করে সবগুলোতেই মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছেন তারা। প্রতি কেজি চিনিতে গড়ে তিনশ মাইক্রোমিটার পরিমাণ প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
যা হিসেবে করলে এক বছরে কেবল চিনির সাথেই অন্তত ২.৪ থেকে ২৫.৬ টন প্লাস্টিক পাওয়া যাবার কথা। জাহাঙ্গীরনগরের গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর চিনির সাথে ১০.২ টন প্লাস্টিক মিশে থাকে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, সুপারশপ থেকে সংগ্রহ করা ব্র্যান্ড এবং নন ব্র্যান্ডের চিনিগুলো মূলত আঁখের রস থেকে উৎপাদনের পর রিফাইন করে প্যাকেজিং করা হয়েছিলো। তবে ঠিক কোন কোন ব্র্যান্ডের চিনি গবেষণার নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তা গোপন রাখা হয়েছে।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, সারাবিশ্বে প্রতি বছর ৩৬৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। যা ব্যবহার হয় গৃহকর্ম থেকে শুরু করে উৎপাদন শিল্পেও। প্যাকেজিং ইন্ডাসট্রি, কনজিউমার প্রোডাক্ট কিংবা ট্রান্সপোর্ট ইন্ডাসট্রি সবখানেই প্লাস্টিকের একচ্ছত্র ব্যবহার।
এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় খাবারের সাথে প্লাস্টিককণা পাওয়া যাবার ঘটনা ঘটেছে। ২০২০, ২১ এবং ২২ এর তিনটি আলাদা গবেষণায় সামুদ্রিক মাছের ভেতর প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
এছাড়া ২০১৪ সালে একটি গবেষণায় আটার মধ্যে, ২০২০ সালের গবেষণায় দুধ, মধু এবং ২০২২ সালের একটি গবেষণায় লবণের মধ্যে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চত করেছেন বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা।
বাংলাদেশে চিনি নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার হিসেবে ধরা হয়। ২০১৯ সালের হিসেবে একজন মানুষ প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ কেজি চিনি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। সেই হিসেবে চিনির সাথে থাকার প্লাস্টিকের কণা গ্রহণের মাত্রাটাও কম নয়।
সম্প্রতি মানবদেহে রক্তে এমনকি মস্তিস্কেও প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই খাবারের মধ্যে প্লাস্টিকের এমন উপস্থিতিতে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন গবেষকেরা।
এটি মানবদেহে কি ধরণের ক্ষতিসাধন করছে তা নিয়ে আলাদা গবেষণা হওয়া উচিত বলে সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণাপত্রে।
চিনি প্রক্রিয়াকরণের ঠিক কোন পর্যায়ে প্লাস্টিক কণা মিশ্রিত হচ্ছে চিনিতে সে বিষয়ে আলাদা গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। চিনির মধ্যে থাকা প্লাস্টিকের কণাগুলোর ছবিও প্রকাশ করা হয় গবেষণাপত্রে।
কালো, গোলাপী, বাদামী এবং নীল রংয়ের এসব প্লাস্টিক কণার মধ্যে রয়েছে এবিএস, পিভিসি, পিইটি, ইভিএ, সিএ, পিটিএফই, এইচডিপিই, পিসি ও নাইলন ধরণের কণা।
প্লাস্টিক কণা রক্তে বা মানবদেহের ভিতরে ঠিক কী কী ধরণের ক্ষতিসাধন করতে পারে তা নিয়ে সরাসরি কোন গবেষণা না থাকলেও ইঁদুরসহ বহু প্রাণীর দেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গবেষণা হয়েছে বহির্বিশ্বে।
এসব ক্ষেত্রে রক্তে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি শরীরের কোষ নষ্ট করে দেয়ার পাশাপাশি এ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। পাশাপাশি ফুসফুসের ক্ষতিসাধন করে ফুসফুস ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে জানানো হয়েছে সেসব সায়েন্স জার্নালে।
পাশাপাশি খাবারে প্লাস্টিক কণার এমন উপস্থিতির কারণে খাবার হজমে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সম্মুখীন হবার আশঙ্কার কথাও জানান বিজ্ঞানীরা।