নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো—
দুনিয়াবিমুখ হওয়া : দুনিয়া থেকে যখন আপনি বিমুখ থাকবেন তখন মানুষ আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করবে, এটাই চিরসত্য কথা। সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন, যা আমি করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালোবাসবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলম্বন করো। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের কাছে যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাও, তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে। (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব, হাদিস : ৩২১৩)
মানুষের অবস্থা বিবেচনা করা : আপনি যদি সমাজের নেতা বা শীর্ষস্থানীয় কোনো ব্যক্তি হন, তাহলে অবশ্যই মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে তাদের ছোট-বড় সব বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। কারণ মানুষের মানসিক অবস্থা অপরিবর্তিত নয়। সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা এ ধরনের নানা পরিস্থিতি মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই মানুষের দিলে প্রভাব বিস্তার করে তাদের আপন করে নেওয়া। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, এক সাহাবি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর শপথ! আমি অমুকের কারণে ফজরের নামাজে অনুপস্থিত থাকি। তিনি (জামাতে) নামাজকে খুব দীর্ঘ করেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে নসিহত করতে গিয়ে ওই দিনের মতো এত অধিক রাগান্বিত হতে আর কোনো দিন দেখিনি। তিনি বলেন, তোমাদের মাঝে বিতৃষ্ণা সৃষ্টিকারী আছে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ অন্যদের নিয়ে নামাজ আদায় করে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্য দুর্বল, বৃদ্ধ ও কর্মব্যস্ত মানুষ আছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০২)
সালাম দেওয়া
ছোট-বড় সবাইকে সালাম দেওয়া এবং সালামের প্রচার-প্রসার করা। এর দ্বারা মানুষ আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করবে। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া। শুধু পরিচিতদের মাঝেই সালাম দেওয়া কিয়ামতের আলামত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দেব না, কী করলে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পর বেশি সালাম বিনিময় করবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৮)
পরস্পর হাদিয়া দেওয়া : একে অন্যকে উপঢৌকন দেওয়া ভালোবাসা ও প্রীতির স্বীকৃত মাধ্যম। কারণ হাদিয়া কারো প্রতি মন্দ ধারণাকে দূর করে এবং অন্তরে ভালোবাসার বীজ বপন করে। এ জন্য সামান্য জিনিসও যদি হয় তা-ও দিতে কার্পণ্য না করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেন, তোমরা পরস্পর উপহার বিনিময় করো, তোমাদের পারস্পরিক মহব্বত সৃষ্টি হবে। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৯৪)
বিনয়ী হওয়া : বিনয় এমন একটি গুণ, যা মানুষের ভালোবাসা টেনে আনতে সক্ষম। বিনয়ী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষের দিলে ভালোবাসা ঢেলে দেন। কারণ বিনয়ের মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। আলা ইবনে আবদুর রহমান (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর পথে সদকা করলে সম্পদ কমে না। ক্ষমা দ্বারা সম্মান বৃদ্ধি হয় এবং নম্রতা প্রদর্শনকারীর মর্যাদা আল্লাহ তাআলা বাড়িয়ে দেন। (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদিস : ১৮২৬)
মিষ্টভাষী হওয়া : কথার মধ্যে কোমলতা, অন্য রকম ভঙ্গিতে উপদেশ দেওয়া, এর প্রভাব অন্য রকম হয়। অন্যকে শোধরানোর এই সুন্দর কৌশল এতে পারস্পরিক বন্ধন যেমন থাকে, তেমনি তাদের মাঝে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয় না। আর যদি উপদেশ হয় নীরস ভঙ্গিতে কিংবা রূঢ় ভাষায় তাহলে এর প্রভাব হবে ভিন্ন রকম। এ জন্য নিজের সুন্দর কথা দ্বারা মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলেন যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন তারপর আপনি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর ওপর নির্ভর করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
অন্যকে মূল্যায়ন করা : মানুষের স্বভাব সে অন্যের কাছে মূল্যায়ন ও সম্মান আশা করে। আপনি যখন অন্যকে মূল্যায়ন করবেন তখন সে-ও আপনাকে ভালোবাসবে এবং মূল্যায়ন করবে। প্রিয় নবীর এই হাদিসটি আমাদের এ দিকেই ইঙ্গিত করে। আবু রিফাআ (রা.) বলেন, আমি যখন নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছলাম, তখন তিনি খুতবা দিচ্ছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! এক আগন্তুক তার দ্বিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। … বর্ণনাকারী বলেন, এরপর একটি চেয়ার আনা হলো। … রাসুল (সা.) তাতে বসে আল্লাহ তাঁকে যা শিখিয়েছেন তা আমাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন, অতঃপর এসে তাঁর অবশিষ্ট খুতবা শেষ করেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯১০)
হাসিমুখে কথা বলা : সর্বদা হাসিমুখে থাকা মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। আপনি যদি সারাক্ষণ গোমড়া মুখ নিয়ে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাহলে এর প্রভাব এক রকম হবে। আর যদি মুচকি হেসে মানুষের সঙ্গে মিলিত হন তাহলে মানুষের দিলে আপনি জায়গা করে নিতে সক্ষম হবেন। রাসুল (সা.)-এর জীবনে এমন অসংখ্য বর্ণনা আছে। জারির (রা.) বলেন, আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছি, তখন থেকে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে তাঁর কাছে প্রবেশ করতে বাধা দেননি এবং যখনই তিনি আমার চেহারার দিকে তাকাতেন তখন তিনি মুচকি হাসতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩০৩৫)