এ ধরনীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত নারী। মায়ের জাতি নারী। ইসলাম নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন নারীর জীবন ও জীবিকা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মর্জির ওপর নির্ভর করত। সে জীবন থেকে নারীকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। বসিয়েছে সম্মানের আসনে। হাদিসে ঘোষণা করা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।
নারী জাতি সঠিক পথে চললে পুরো পরিবার পাবে সঠিক পথের দিশা। এ কারণেই নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি শিক্ষিত জাতি দেব।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, আদর্শ, মার্জিত রুচিবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মা পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও সন্তানদের জন্য আদর্শ।
মানুষ সভ্য জীব। আর সভ্যতার অন্যতম পরিচায়ক হচ্ছে শালীনতা। অশালীন চালচলন সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা কোনো সমাজেই শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সভ্য জীব হিসেবে মানুষের সভ্যতার অন্যতম বাহন হচ্ছে পোশাক বা পরিচ্ছদ। শুধু লজ্জা নিবারণই নয়, একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, তার শালীনতা বোধ এবং সামাজিক অবস্থান অনেকটাই নির্ভর করে তার পোশাকের ওপর। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়। আদিম গুহাবাসী মানুষ একদা বন্যপশুর মতোই দিগম্বর ছিলেন। খাদ্য অন্বেষণে যাযাবর মানুষ ক্রমে পশুপালন ও চাষাবাদ ব্যবস্থা প্রচলনের পর্যায়ে মানবিক চিন্তা-চেতনা ও বিবেক-বুদ্ধির বিকাশে সমাজ, গ্রাম ও লোকালয়ের পত্তন শুরু করেন। আর এ পর্যায়ে লজ্জা-শরমের বিষয়টি অনুভূত হওয়ায় আদিম মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের লতাপাতা, ছাল-বাকল, পশুপাখির চামড়া ও পালক পরিধান করতে শুরু করে।
কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা অধিক করুন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুনাফা লুণ্ঠনের ফন্দি-ফিকিরের জন্য বিকৃত রুচির পোশাকের কাটতি বাড়াতে ফ্যাশন নাম দিয়ে তা করা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এর অনুকরণ-অনুসরণ সব দিক থেকে অকল্যাণকর। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখতে হবে। যে পোশাক আদিম মানুষকে সভ্যতায় উন্নীত করেছে, আধুনিক ফ্যাশনের নামে তার ডিজাইন যদি পুনঃমানুষের আদিমতাকেই উসকে দেয় তা কোনোভাবে রুচিশীল, মার্জিত পোশাক বলে বিবেচিত হতে পারে না। মনে রাখতে হবে পোশাক শুধু জীবনে নয়, মরণেও থাকবে।
পোশাক-পরিচ্ছদ মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম অনুষঙ্গ। দেহ সজ্জিত করা এবং সতর (শরীর) আবৃত করার প্রয়োজনীয় মাধ্যম। তা ছাড়া এটি ব্যক্তিত্ব প্রকাশেরও অনন্য উপকরণ। কুরআন মাজিদের এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পোশাকের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দোষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যেরও উপকরণ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক সেটিই সর্বোত্তম। এসব আল্লাহর নির্দেশনাবলির অন্যতম, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা : আরাফ : ২৬)
সতর আবৃত করা : পোশাক-পরিচ্ছদ এমন হতে হবে, যা পুরো সতর আবৃত করে। পুরুষের জন্য নাভী থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর পুরো শরীর সতর। পোশাকের মূল উদ্দেশ্যই সতর ঢাকা। পোশাক প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি পোশাক, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সৌন্দর্য দান করে।’ (সূরা আল আরাফ : ২৬)
সুতরাং যে পোশাক এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ, তা যেন শরিয়তের দৃষ্টিতে পোশাকই নয়!
নারী-পুরুষ স্বতন্ত্র পোশাক পরিধান করা : হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সা: অভিসম্পাত করেছেন ওই পুরুষকে যে নারীর পোশাক পরে এবং ওই নারীকে যে পুরুষের পোশাক পরে। (আবু দাউদ : ৪০৯৮)
খ্যাতির আশায় পোশাক না পরা : প্রতি ঈদ বাজারে পোশাক কারখানাগুলো পরিচিত মডেল এবং টিভি সিরিয়ালের নামে বাহারি পোশাক বাজারজাত করে থাকে। আর উঠতি ছেলেমেয়েদের এসব পোশাকের প্রতি থাকে বাড়তি আগ্রহ। অথচ রাসূলুল্লাহ সা: এসব পোশাক না পরার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির পোশাক পরবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। অতঃপর তাকে অগ্নিদগ্ধ করা হবে।’ (আবু দাউদ : ৪০২৯)
পোশাক পরিধানে কৃপণতা না করা : অপচয় ও কৃপণতা সর্ব ক্ষেত্রেই নিন্দনীয়। পোশাক-পরিচ্ছদেও এর ব্যতিক্রম নয়। সামর্থ্য থাকার পরও কেউ যদি কৃপণতা করে নিম্নমানের পোশাক পরিধান করে ইসলামে তাদের অপছন্দ করা হয়েছে। একবার আবুল আহওয়াসের পিতা মালিক বিন আউফ রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এলেন। তখন তাঁর পরনে ছিল অতি নিম্নমানের পোশাক। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি সম্পদ আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, কী সম্পদ আছে? আমি বললাম, সব ধরনের সম্পদই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, গোলাম প্রভৃতি। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, ‘যখন আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন তখন তোমার ওপর তাঁর নিয়ামতের ছাপ থাকা চাই। ’ (নাসাঈ : ৫২৯৪)
পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখা : পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে সতর আবৃত করার পাশাপাশি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিপাটি রাখা ইসলামের নির্দেশনা। সাহল বিন হানজালিয়া রা: বলেন, কোনো এক সফর থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর প্রিয় সাহাবাদের লক্ষ করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইদের কাছে আগমন করছ। সুতরাং তোমাদের হাওদাগুলো গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোশাক পরিপাটি করো, যাতে তোমাদের (সাক্ষাৎ করতে আসা) মানুষের ভিড়ে তিলকের মতো (সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন) মনে হয়। (জেনে রেখো) আল্লাহ তায়ালা স্বভাবগত নোংরামি বা ইচ্ছাকৃতভাবে নোংরা থাকা, কোনোটাই পছন্দ করেন না।’ (আবু দাউদ : ৭০৮৩)
প্রদর্শনের মানসিকতা পরিহার করা : অহঙ্কার বা মানুষ দেখানোর মানসিকতা সর্বাবস্থায় সব কাজেই নিন্দনীয়। পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমেও যেন এই ব্যাধি মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও হাদিস শরিফে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এক হাদিসে নবী করিম সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না (রাগান্বিত থাকবেন)। (বুখারি : ৫৭৯১)
বিধর্মীদের পোশাক না হওয়া : বিধর্মীদের অনুকরণে পোশাক পরিধান করা নাজায়েজ। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অমুসলিমদের পোশাক পরবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (তবারানি আওসাত : ৩৯২১)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পোশাকের প্রতি যতœবান হওয়ার তাওফিক দান করুন।