আপাতত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কোনো রূপরেখা দেবে না বিএনপি। আগে সরকারের পদত্যাগ, পরে এই ইস্যুতে প্রয়োজনে রূপরেখা দেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে কঠোর আন্দোলনেই সমাধান দেখছে দলের হাইকমান্ড। সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের।
এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা আলোচনার টেবিলেই চূড়ান্ত হতে পারে, এমনটি ভাবছেন শীর্ষ নেতারা। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলে সমঝোতায় পৌঁছা জটিল কিছু নয়। পদত্যাগের আগে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীনরা আলোচনার প্রস্তাব দিলে তাতে সাড়া দিতে পারে বিএনপি। তবে তারা এজেন্ডা ছাড়া কোনো সংলাপে যাবে না।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ে নেওয়া হচ্ছে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি। সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। যুগপৎ আন্দোলন ও ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা শিগগিরই জাতির সামনে তুলে ধরবেন দলের হাইকমান্ড। তবে সেখানে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত কিছু থাকছে না বলে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আপাতত নির্বাচনকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে আমাদের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ধরনের কোনো ফর্মুলাও আমরা দিচ্ছি না। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নতুন করে দিতে হবে কেন। এটা তো সংবিধানেই ছিল। সেটা ফিরিয়ে আনলেই হয়। বিচারপতিকে দেওয়া যাবে না বলে আদালতের রায় আছে। সেটা পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসতে হবে। এটা সম্ভব। নির্বাচনকালীন সময় একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকতে হবে, এটাই আমাদের মূল দাবি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগের পরে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে আমরা তখন পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নেব।
বিএনপি সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেওয়া হলে তা নিয়ে ক্ষমতাসীনরা নানা বিতর্ক তৈরি করতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা হতে পারে সেই প্রস্তাব। তাছাড়া রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের হিসাব করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নাও নিতে পারে। আগেভাগে এমন কিছু উপস্থাপন করা ঠিক হবে না। তাই সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে এমন দাবিকেই তারা সামনে আনছে।
নির্বাচনকালীন সরকারের বিধানটি সংবিধানে নেই। আওয়ামী লীগ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে আর সংযুক্ত করা হবে না। তাহলে সরকার পদত্যাগ করলে কার কাছে ক্ষমতা ছাড়বে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। সেই প্রশ্নের জবাবও তৈরি করছেন দলটির নেতারা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবি একটাই এ সরকারকে বিদায় নিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে হতে হবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংকটের কিছু দেখছি না। সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকার পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি তখন সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। তিনি সব দলকে আলোচনার টেবিলে ডাকতে পারেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে গঠন করতে পারেন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। সব দল চাইলে সংবিধান কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক বলেন, গণআন্দোলনের মুখে এইচএম এরশাদ ১৯৯০ সালের শেষদিকে ক্ষমতা ছাড়েন। ওই সময় সব দলের সমঝোতার ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়, যা সংবিধানে ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ অনেকেই মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ভোট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। নানা অনিয়মে নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। তাই নির্বাচন নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা জরুরি। না হলে রাজপথে বাড়বে রাজনৈতিক সহিংসতা, যা কারও জন্যই কাম্য নয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখাও তুলে ধরে। কিন্তু ওই সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে বিএনপির সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
আস্থাভাজন লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার লক্ষ্যেই বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগ করে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক চরম অস্থিরতার মধ্যে ওই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা দুই বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়। সেই ভোটে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা না-থাকা নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন সুপ্রিমকোর্ট। পরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু এক সময়ের বিরোধিতাকারী বিএনপি ফের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে এ দাবিতে রাজপথে তীব্র আন্দোলন করে। কিন্তু সরকার বিএনপির সেই দাবিকে আমলে নেয়নি। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর নির্বাচনকালীন সরকারের নতুন রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে বর্তমান সরকারি দল ৫ জন এবং বিরোধী দল ৫ সদস্যের নাম প্রস্তাব করবেন। তারাই আসন্ন নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা হবেন। সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিককে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নির্ধারণ করবে। তবে বিএনপির এমন প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দাবি না মানায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি।