এক মাসের বেশি সময় ধরে সীমান্তের ওপাশে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। কয়েক দফায় বাংলাদেশেও এসে পড়েছে গোলা ও মর্টার শেল। মিয়ানমার সীমান্তে এক ধরনের অস্থিরতা থাকলেও তার তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না মাদক কারবারে। গুলি, মর্টার শেলের প্রচণ্ড শব্দ সীমান্তবাসীর হৃদয়ে কাঁপন ধরালেও পিছু হটেনি ইয়াবা কারবারিরা। নানা কৌশলে তারা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে নানা কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে একাধিক বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনের চলছে লড়াই। এর মধ্যেও ইয়াবা কারবারিরা সক্রিয়।
সর্বশেষ গত বুধবার টেকনাফের নাফ নদ থেকে ৯০ হাজার পিস ইয়াবার একটি বড় চালান জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর উখিয়ার রাজাপালংয়ের তিন ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করে বিজিবি। তাদের কাছে থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। যার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। তার আগে ২ সেপ্টেম্বর বিজিবির ঘুমধুম বিওপির একটি বিশেষ দল উখিয়ার পালংখালি এলাকায় ওঁৎ পেতে আবু হেনা মোস্তফা নামে এক ইয়াবা কারবারিকে আটক করে। তার কাছে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।
এর আগে ২৮ আগস্ট রাজাপালংয়ের পূর্ব দীঘলিয়া এলাকা থেকে নুরুজ্জামান নামে একজনকে আটক করা হয়। তার কাছে পাওয়া যায় ৭৩ হাজার পিস ইয়াবা।
এ ছাড়া উখিয়া থেকে সম্প্রতি ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা নারীকে গ্রেফতার করে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।
কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে একের পর এক ছোটবড় ইয়াবার চালান জব্দ হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় মাদক কারবারিরা কত বেপরোয়া। মিয়ানমারের জান্তা সরকার তাদের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মিসহ একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত। এর উত্তাপ ছড়াচ্ছে সীমান্তের এপারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় কিছুদিন ধরেই নিরাপত্তা জোরদার করে বিজিবি।
নিরাপত্তা বিশ্নেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা সরকারের সাথে তাদের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর যে লড়াই চলছে তার নেপথ্যের কারণ একটি সীমান্ত ঘিরে অবৈধ কারবারের নিয়ন্ত্রণ। ইয়াবাসহ নানা ধরনের চোরাই পণ্য সীমান্তপথে পাচার হয়ে থাকে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো এসবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চায়। আবার জান্তা সরকার সীমান্ত কারবারের ‘মধু’ থেকে দূরে থাকতে চায় না। তাই সীমান্তে উত্তেজনা ও কড়াকড়ির মধ্যে মাদক কারবারিরা সক্রিয়। মর্টার শেল পড়ছে, জেট বিমান প্রায়ই মিয়ানমার সীমান্তে চক্কর দিচ্ছে। তবু ভীত নয় মাদকের সাথে সংশ্নিষ্টরা।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) উখিয়া উপজেলার আহ্বায়ক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ভালো নেই উখিয়া ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকার মানুষেরা। একদিকে মিয়ানমারের গুলির শব্দ, অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। তাছাড়া রয়েছে উখিয়া-টেকনাফে ইয়াবার বদনাম। পাশাপাশি মাঝে মধ্যে অভিযানে মিলছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। অস্থিরতা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মনে। ভাবিয়ে তুলেছে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যত নিয়ে।
এদিকে চলতি বছর মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তের ৯৫ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে মাদক। আর ১৯ জেলার মধ্যে পড়েছে এসব পয়েন্ট। প্রতিবেদনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুটের কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, এসব রুট দুর্গম এলাকায় হওয়ায় ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা তৈরি করে ইয়াবা উৎপাদন করা হয়। নানা কৌশল ব্যবহার করে বাংলাদেশে ঢোকানো হয় এই মাদক। ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করা হয় রোহিঙ্গাদের। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মাদক পাচারের ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার ও পাঁচটি বান্দরবান সীমান্তে।
সর্বশেষ গত বুধবার মিয়ানমার থেকে নাফ নদী দিয়ে একটি নৌকা শূন্যরেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে দেখে টহলরত বিজিবি সদস্যরা সেটিকে ধাওয়া করে। এ সময় নৌকায় থাকা লোকজন লাফ দিয়ে সাঁতরে মিয়ানমারের দিকে পালিয়ে যায়। পরে ওই নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে ৯০ হাজার পিস ইয়াবা, এক প্যাকেট রিচ কফি, তিন কেজি শুঁটকি, ১০ প্যাকেট বার্মিজ সিগারেট, পাঁচ প্যাকেট বিস্কুট, দু‘বোতল পানীয় জব্দ করা হয়। জব্দ মাদক ও অন্যান্য পণ্যের বাজার মূল্য আনুমানিক দু’কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
এছাড়া কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার গহীন পাহাড় থেকে দুটি দেশী বন্দুক, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম এবং বালু উত্তোলনের তিনটি ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে টানা আড়াই ঘণ্টা উপজেলার থাইংখালী তেলখোলার গহিন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে এসব জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন, বনবিভাগ ও পুলিশের যৌথ দল।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, পাহাড়ের একটি পরিত্যক্ত ঘরের সুড়ঙ্গে এসব অস্ত্র ও সরঞ্জামের খোঁজ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, তেলখোলার গহীন পাহাড়ের একটি ঝুপড়ি ঘর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় দুটি দেশীয় অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি।
আনন্দ উৎসব ঘিরে আতঙ্ক
আগামীকাল রোববার থেকে শুরু হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব। এই উৎসব আনন্দে, আবেগে মেতে ওঠার। কিন্তু মিয়ানমারের মর্টার শেল ও গোলাগুলিতে তুমব্রু সীমান্তে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭ পরিবারের মাঝে এই উৎসব উদযাপনেও এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। দুর্গাপূজার প্রস্তুতির ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে এমন মন্তব্য করেন তুমব্রুর মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি রূপলা ধর।
নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়নের তুমব্রুর ১ নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দু পাড়ার বসতি। এটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতার থেকে দুই শ’ গজ ভেতরে। সেখানে দুর্গা মন্দির রয়েছে। যার আশপাশে ১৭ পরিবারের ১২০ জন রয়েছে।
মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সভাপতি রূপলা ধর বলেন, ‘অন্য বছরের তুলনায় আমরা দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সীমান্তে যেভাবে মার্টার শেল ও গোলাগুলি চলছে এখন উৎসব উদযাপনে ভয়ে আছি। কারণ কখন মাথায় মর্টার শেল এসে পড়ে বলা যায় না।’
সীমান্তে গোলাগুলি কমেছে
নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তে দীর্ঘ দিন ধরে চলমান মার্টার শেল ও গোলাগুলির শব্দ কমেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বৃহস্পতিবার রাতে কোনো ধরনের গুলির শব্দ পাওয়া না গেলেও দিনে দু-একটি গুলির শব্দ ছিল।
তুমব্রুর সীমান্তের নারী ইউপি সদস্য আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অনেক দিন পর রাতে শান্তির ঘুম হয়েছে। কারণ কোনো ধরনের গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি।’
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান জানান, গুলির শব্দ কমে আসায় সীমান্তের মানুষের মাঝে একটু স্বস্তি এসেছে। বিশেষ করে কৃষকরা খুশি। তারা নির্ভয়ে ক্ষেত-খামারে যেতে পারছে।