অনলাইন ডেস্ক:
জিয়াউর রহমানের কবর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি দেওয়া ১৩ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। একইসাথে সেসময়ের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন ও জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন তারা।
সোমবার (৭ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গের আয়োজনে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’র আলোচনা সভায় তারা এ দাবি করেন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান যখন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা নেন, তার অনুগত সৈনিকদের হাতে প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ, এটি এম হায়দার ও সাব সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদা। এই দিনটি কেন্দ্র করে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই স্বাধীন দেশে প্রথম ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সশস্ত্র বাহিনীতে হাজার হাজার সৈনিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। জিয়া হত্যার ঘটনায় প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।
শহীদ সার্জেন্ট দেলোয়ার হোসেনের সন্তান নুরে আলম বলেন, আমার বাবার খুনি জিয়া। জিয়াউর রহমান আমার বাবাসহ হাজার মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-সৈনিকদের হত্যাকারী। আমার বাবাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের পরিবারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে তিনি জেলে আছেন। কিসের মানবাধিকারের কথা বলে বিএনপি, তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার?
এ সময় হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি করেন তিনি।
শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের মেয়ে মাহজাবিন খালেদ বলেন, যদি আমার চেহারা দেখেন বাবার চেহারা ভাসে। বিএনপি-জাসদকে বলবো আপনারা বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার দিন কিসের বিপ্লব ও সংহতি! আপনারা ইতিহাসকে বিতর্কিত করবেন না।
এ সময় আক্ষেপ করে তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে আছি, আওয়ামী লীগ সরকার আছে- তারপরও বিচার কী হবে না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাঈদুর রহমানের সন্তান কামরুজ্জামান মিয়া লেলিন বলেন, বিচার অবশ্যই করা উচিত- এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। জিয়াউর রহমান যে ১৪০০ সেনা-বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে সেই বিচারটা হোক।
শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রমের কন্যা নাহিদ ইজাহার খান বলেন, আমার বাবাকে সংসদ ভবনে হাঁটার সময় হত্যা করা হয়। ভাবছিলাম বাবা শেষ কি বলতে চেয়েছিলেন। আমি তখন ৫ বছর, আমার ভাই ৮ বছর। আমি তখন বুঝতাম না মৃত্যু কী জিনিস। আমার বাবার মৃত্যুই প্রথম মৃত্যু। বাবাকে দেখলাম খাটিয়ায়, তাকে দাফন করলাম ১০ ডিসেম্বর। আমার মনে হয় বাবা শেষ কথা হিসেবে বলতে চেয়েছিলো, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকাকে যেন সবসময় সম্মান করি।
তিনি বলেন, আমরা দু’বছর কোনো স্কুলে পড়তে পারিনি। জিয়াউর রহমানের এখনে যে ছবি আছে- দেখেন কী হিংস্র চোখ। এক মিনিটের শুনানিতে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যেত হত্যা করতে বা ফাঁসিতে ঝোলাতো। জিয়ার তৎকালীন এডিসি মীর সাবিউল আলম জানিয়েছেন, তিনি নির্লিপ্তভাবে সই করে দিতো। তখন মানবাধিকার সংস্থা কোথায় ছিলো?
‘বিএনপি এখন পর্যন্ত এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। এদেশে তাদের বিচার হওয়া উচিত। খুনি জিয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের যে কবর রয়েছে সেই কবর সরিয়ে ফেলা হোক সংসদ ভবন থেকে।’
এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দায় রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ইজাহার খান। তিনি বলেন, উনি ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার, উনার কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। এই অপরাধগুলো, অন্যায়গুলোর বিচার হোক। এসময় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের মরণোত্তর গার্ড অব অনার দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম বলেন, ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস। খুনি জিয়ার কবর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাহলে এখানে উত্থাপিত অন্য দাবিও পূরণ হবে। বে-আইনীভাবে যাদের বিচার হয়েছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
সশস্ত্র বাহিনীতে ৭ নভেম্বর থেকে ঘটা বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করেছেন লেখক ও সাংবাদিক আনোয়ার কবির। মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’র আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, তদন্ত কমিশন গঠন করে কোর্ট অব ইনকোয়ারি করা হোক। হত্যার বিচার যেকোনো সময় করা যায়।
সশস্ত্র বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক-কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু আর সর্বশেষ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড দিয়ে শেষ হয়। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সবগুলো হত্যাকাণ্ডের শিকার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার।
বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক রায়ে স্পষ্ট বলেছেন, এ ঘটনাগুলো আদালতে তদন্ত কমিশন গঠন করতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও যেন কোর্ট অব ইনকোয়ারির ব্যবস্থা করে। সেটা যদি না করে, সেনাবাহিনী কী জবাব দেবে জাতির কাছে? সেনাবাহিনীকে তো একটা জবাব দিতে হবে। সেনাবাহিনীকে দায়মুক্তি পেতে হলে কোর্ট অব ইনকোয়ারি করতে হবে। না হলে কীভাবে দায়মুক্তি পাবে। সেনাবাহিনীকে দায়মুক্তির প্রয়োজনে এটা করতে হবে।
এ আলোচনা সভায় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ও ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গের সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ সময় তিনি শহীদ সন্তানদের উদ্দেশ্যে তদন্ত কমিটি গঠন হচ্ছে বলে জানান।
আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য দেন- সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির।