অনলাইন ডেস্ক:
ক্রিকেট বরাবরই অনিশ্চয়তার খেলা। সেই প্রমাণ আরেকবার মিলল আইপিএলের ফাইনালে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য গড়াল শেষ ওভারে। যেখানে শেষ ওভারের শেষ ছয়টি বলই দুরু দুরু বুকে দেখেছে ক্রিকেট দুনিয়া। কী হয়, কী হয়! বৃষ্টি বোধহয় দু’দিন ধরে এ কারণেই বারবার হানা দিচ্ছিল। নাহলে এমন রোমাঞ্চে ভরা ফাইনালের জন্য অপেক্ষা করা যেত না! গায়ে মাখা হতো না বৃষ্টির ঝিরিঝিরি হাওয়া মৃদু সুরের গান, ফোন ফ্ল্যাশে আলোকিত হওয়া অন্ধকার স্টেডিয়াম। এসবকে সাক্ষী রেখে জেতা শিরোপার মাহাত্ম্য তো বলে বোঝানো ভীষণ কঠিন, তবে ভয়ংকর সুন্দর। শেষ ওভারে রবীন্দ্র জাদেজার জাদুকরি ফিনিশিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস।
মহারণের মহামঞ্চ প্রস্তুত ছিল গত রোববার (২৮ মে) থেকেই। বৃষ্টি এসে একদিনের অপেক্ষা বাড়াল। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে আইপিএলের ১৬তম আসরের ফাইনালে গতকাল সোমবার (২৯ মে) মুখোমুখি হয়েছে গুজরাট টাইটান্স ও চেন্নাই সুপার কিংস। বৃষ্টি আইনে গুজরাটকে ৫ উইকেটে হারিয়ে আইপিএলের পঞ্চম শিরোপা জিতল চেন্নাই। ২০২১ সালের পর আবারও শিরোপা পুনরুদ্ধার করল ধোনিবাহিনী।
টস জিতে গুজরাটকে ব্যাটিংয়ে পাঠান চেন্নাই অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ২১৪ রান করে গুজরাট। জবাবে ১৫ ওভারে চেন্নাইয়ের লক্ষ্য নেমে আসে ১৭১ রানে। সেই লক্ষ্যে নিধারিত ১৫ ওভার শেষে ৫ উইকেট হাতে রেখে ১৭১ রান করে চেন্নাই।
গুজরাটের করা ২১৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে চেন্নাইয়ের ইনিংসের মাত্র তৃতীয় বলেই বৃষ্টির আঘাত। ০.৩ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৪ রান নিয়ে মাঠ ছাড়েন চেন্নাইয়ের দুই ওপেনার রুতুরাজ গাইকোয়ার ও ডেভন কনওয়ে। বৃষ্টিতে প্রায় দুই ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর শুরু হয় খেলা। ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে চেন্নাইয়ের লক্ষ্য নেমে আসে ১৫ ওভারে ১৭১ রানে। প্রকৃতির বর্ষণ বন্ধ হলেও এরপর ক্রিজে ঝড় তোলেন দুই ওপেনার। রুতুরাজ ও কনওয়ে মিলে ৬.৩ ওভারে গড়েন ৭৪ রানের জুটি। ১৬ বলে ২৬ রান করে নূর আহমেদের বলে রশিদ খানের ক্যাচে পরিণত হন রুতুরাজ। একই ওভারে কনওয়েকেও ফেরান নূর। মোহিত শর্মার হাতে ক্যাচ তুলে দেওয়ার আগে চারটি চার ও দুই ছক্কায় ২৫ বলে ৪৭ রান করেন কনওয়ে।
এই দু’জন ফিরে গেলে রানের গতি কিছুটা কমে আসে চেন্নাইয়ের। হাত খুলে খেলতে শুরু করেছিলেন অজিঙ্কা রাহানে। কিন্তু গুজরাটের জন্য হুমকি হওয়ার আগেই তাকে ফেরান মোহিত শর্মা। নিজের প্রথম ওভারে এসেই দলকে এনে দেন ব্রেক থ্রু। বিজয় শঙ্করের তালুবন্দী হওয়ার আগে ১৩ বলে ২৭ রানের ঝড়ে ইনিংস খেলেন রাহানে। শুরুতে রয়েসয়ে খেলা শিভাম দুবে দ্বাদশ ওভারে রশিদ খানকে জোড়া ছয় মারেন। এক ওভারে রশিদ দেন ১৫ রান। ফের আক্রমণে আসেন মোহিত। এবার তার প্রথম তিন বলে ৬, ৪, ৬ মেরে আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন আম্বাতি রাইডু। চেষ্টা করেন বলা, কারণ পরের বলেই ফিরতি ক্যাচ নিয়ে রাইডুকে সাজঘরে ফেরান মোহিত। ৮ বলে ১৯ রান করেন রাইডু।
এরপরই আহমেদাবাদে গর্জন। মাঠে নামছেন ধোনি। আইপিএলে সম্ভাব্য শেষবার। বহুবার ফিনিশিং দিয়েছেন। আজও প্রতিকূল সময়ে নামলেন। তবে এবার হলো না। কিংবদন্তির হয়ে কথা বলল না ব্যাট। মোহিতের বলে ডেভিড মিলারের হাতে ক্যাচ দিয়ে প্রথম বলেই ফিরে গেলেন মাহি।
স্লগ ওভারে আগের ম্যাচে মুম্বাইকে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন মোহিত শর্মা। এদিনও একই কাজ করলেন। দুই ওভারে নিলেন তিন উইকেট। শেষ ওভারে বোলিংয়ে এলেন। চেন্নাইয়ের প্রথম বল ডট। পরের তিন বলে তিন সিঙ্গেল। দুই বলে প্রয়োজন ১০ রান। নন স্ট্রাইকে ২১ বলে ৩২ রানে অপরাজিত দুবে, স্ট্রাইকিং এন্ডে জাদেজা। সেই জাদেজা, যাকে গড়ার অন্যতম কারিগর ধোনি। গুরুর জন্য কি অর্ঘ্য দেবেন না শিষ্য? মোহিতের পঞ্চম বলে মারলেন ছক্কা। এক বলে সমীকরণ দাঁড়াল চার রানে। জাদেজা কী ভাবলেন, একটি মাত্র বল! মাঠের বাইরে ধোনি কী ভাবছেন, এক বলে আমিও পাল্টে দিয়েছিলাম ইতিহাস! মোহিত রান আপ নিলেন, জাদেজার শট এবং কাঙ্খিত চার! চেন্নাই চ্যাম্পিয়ন!
এর আগে আলো ঝলমল সন্ধ্যায় টস হেরে গুজরাট অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া মজার ছলেই বলছিলেন, আমরাও বোলিং নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মন ব্যাটিং নিতে চাইছিল। অধিনায়কের মনের কথা শুনেছেন দুই ওপেনার শুভমান গিল ও ঋদ্ধিমান সাহা। ওপেনিং জুটিতে সাত ওভারে তোলেন ৬৭ রান। যথারীতি হাত খুলে খেলছিলেন আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান গিল। সাত চারে ২০ বলে ৩৯ রান করেন তিনি। বিপদ আরও বাড়ার আগে সপ্তম ওভারের শেষ বলে তাকে ফেরান রবীন্দ্র জাদেজা। উইকেটের পেছন থেকে গিলকে স্ট্যাম্পড করেন ধোনি। আইপিএলে নিজের আড়াইশতম ম্যাচের মাইলফলকেও দেখা গেল সেই পুরোনো ধোনির ঝলক।
প্রথম উইকেটে স্ট্যাম্পিং করা ধোনি পরের উইকেটে অবদান রাখলেন ক্যাচ নিয়ে। দীপক চাহারের বলে উইকেটের পিছে থাকা ধোনির হাতে ক্যাচ তুলে দেন গুজরাটের অপর ওপেনার ঋদ্ধিমান। আউট হওয়ার আগে খেলেন ৩৯ বলে ৫৪ রানের ইনিংস। ফিফটি করেন গুজরাটের ব্যাটার সাই সুদর্শন। অর্ধশতকের পর যেন আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন তিনি। খেলতে থাকেন আউট অব দ্য বক্স সব শট। শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরির খুব কাছাকাছি গিয়ে আটটি চার ও ছয়টি ছক্কায় ৪৭ বলে ৯৬ রান করে মাহিশ পাথিরানার বলে লেগ বিফোর হন সুদর্শন। চার রানের আক্ষেপ নিয়ে ফিরে গেলেও ততক্ষণে দলকে পার করান ২০০ রান। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে ১২ বলে ২১ রানে অপরাজিত থাকেন অধিনায়ক পান্ডিয়া।
২০১০-২০১১ তে চেন্নাই, ২০১৯-২০২০ এ মুম্বাইয়ের পর গুজরাটকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল তৃতীয় দল হিসেবে টানা দুই শিরোপা জয়ের। আর চেন্নাইকে হাতছানি দিচ্ছিল মুম্বাইকে ছুঁয়ে ফেলা পঞ্চম শিরোপা বগলদাবা করার। কথায় বলে, শেষ থেকে নতুন শুরু হয়। এর প্রমাণ মিলল আরেকবার। চেন্নাই এখন আইপিএলে সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ে যৌথভাবে শীর্ষে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
গুজরাট টাইটান্স : ২০ ওভারে ২১৪/৪ (ঋদ্ধিমান ৫৪, গিল ৩৯, সুদর্শন ৯৬, পান্ডিয়া ২১, রশিদ ০, দিপক ৪-০-৩৮-১, তুষার ৪-০-৫৬-০, মাহেশ ৪-০-৩৬-০, জাদেজা ৪-০-৩৮-১, পাথিরানা ৪-০-৪৪-২)।
চেন্নাই সুপার কিংস : (বৃষ্টি আইনে টার্গেট ১৭১) ১৫ ওভারে ১৭১/৫ (গায়কোয়ার্ড ২৬, কনওয়ে ৪৭, রাহানে ২৭, দুবে ৩২, রাইডু ১৯, ধোনি ০, জাদেজা ১৫ ; শামি ৩-০-২৯-০, পান্ডিয়া ১-০-১৪-০, রশিদ ৩-০-৪৪-০, নুর ৩-০-১৭-২, মহিত ৩-০-৩৬-৩, লিটল ২-০-৩০-০)।
ফল : ৫ উইকেটে জিতে চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংস।