নক্শবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া ত্বরিকার অধ্যাত্মা শরাফতের প্রাণ পুরুষ
হযরত গওছুল আ‘যম খুলনবী (রহ.) স্মরণে
ডা.মোহাম্মদ এনামুল হক (এনাম)
পাক-ভারত উপমহাদেশে নক্শবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া ত্বরিকার প্রচার-প্রসারে যে সমস্ত সূফী-সাধক অনন্য ভূমিকা পালন করে সহজে আল্লাহ প্রাপ্তির পথ সুগম করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছেন মাহবুবে রহমান, সুলতানুল আউলিয়া, হামিয়ে সুন্নাত, মাহিয়ে বেদআত, ত্বরিকত পন্থীদের হৃদয়ের স্পন্দন,হযরত শাহ সূফী গওছুল আ‘যম আব্দুল আজিজ খুলনবী (রহ.)। তিনি তৎকালীন খুলনা জেলার সাতক্ষীরা থানার আশাশুনী চাপরা গ্রামে বাংলা ১২৮২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। বংশীয় শজরা অনুসারে তিনি ছিলেন আওলাদে রাসুল (দ.)। সে হিসাবে হুজুরের সম্মানিত মাতা- পিতা উভয়ই ছিলেন পূণ্যাত্মার অধিকারী এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেককার পরহেজগার ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা জীবনের ধারাবাহিকতায় দেশে এবং বিদেশের খ্যাতনামা দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করত: আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মহা আর্কষণে জীবনের অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে পাক ভারত উপমহাদেশের ত্বরিকত স¤্রাট, ইমামে রব্বানি মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) র পবিত্র বংশধর, সকল ত্বরিকতের অন্যতম ধারক ও বাহক, এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম পবিত্র ঐতিহাসিক জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) এর প্রবর্তক, তৎকালিন দিল্লী শাহী জামে মসজিদের খতিব, বেলায়তের সূর্য, নক্শবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া তরিকার মহান শায়খ, হযরত গওছুল আ‘যম মহিউদ্দিন আব্দুল্লাহ আবুল খায়ের ফারুকী নক্শবন্দী মোজাদ্দেদী দেহলবী (রহ.) এর নিকট বায়াত গ্রহন করেন। এরপর পীরে মুর্শিদের সান্নিধ্যে থেকে কঠিন রিয়াযত, কঠোর সাধনা, ধৈর্য্য ও ত্যাগের মাধ্যমে বহু বন্ধুর পথ অতিক্রম করত: মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত ও দয়ায়, রাসুলে পাকের ইশারায় আধ্যাত্মিক বিজয়ের মুকুট লাভে ধন্য হন। স্বীয় মুর্শিদের অনুমতিতে নিজ দেশে ফিরে নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন ত্বরিকত তথা দ্বীন-ইসলামের প্রচার প্রসারে। তিনি মুলত সকল ত্বরিকতের খেলাফত তাঁর প্রাণপ্রিয় পীরে মুর্শিদের কাছ থেকে লাভ করেছেন। নকশবন্দীয়া ত্বরিকার মাধ্যমে তিনি বেশি লাভবান হয়েছেন বিধায় তাঁর সকল খলিফা ও মুরিদানদের নক্শবন্দীয়া ত্বরিকায় বায়াত করিয়েছেন। হযরত খুলনবী (রহ.) এমন এক মহান সত্ত্বা, এমন এক মহান জাতে পাক, যা আমাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বড় নেয়ামত, যাঁর গুণাবলী বর্ণনা তো দূরের কথা, তাঁর গোলামদের গোলামের শান-মান বর্ণনাও আমার মতো গুনাহগার অধমের পক্ষে জীবনেও সম্ভব নয়। শুধুমাত্র বরকত হাছিল ও নিজেকে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভূক্তির উদ্দেশ্যে এ প্রচেষ্টা। তিনি আল্লাহর পথে মানুষকে কুরআনুল করিমের শিক্ষা দান, মসজিদে, মাহফিলে ওয়াজ নছিহতের মাধ্যমে শরীয়ত ও ত্বরিক্বতের প্রয়োজনীয় মাসয়ালা মাসায়েলের উপর সারগর্ভ রুহানী ত্বকরির পেশ করতেন।ফলে অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের হৃদয় এমনভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, গওছিয়তের জ্যোর্তিময় আলোকচ্ছটা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম তৈরির জন্য দরছে নেজামী প্রতিষ্ঠা করেন। জ্ঞানাস্ত্রের অপ্রতিরোধ্যতা, ও এর কার্যকারিতার সফলতা বিশ্ব স্বীকৃত বিষয়। তা তিনি অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন বলে ত্বরিক্বতের দীক্ষার সাথে সাথে যেখানে সফর করেছেন, সেখানেই খাঁটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার গুরুতা¡রোপ করেছেন। প্রিয় রসুলের যোগ্য উত্তরসূরী তৈরির লক্ষ্যে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তিনি এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর সম্পর্কে হযরত গওছে পাক আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর একটি বাণী দিয়ে বলতে চাই-“হে বৎস! তুমি আহলে দিল ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহন করো, যাতে তুমিও পরিশুদ্ধ আত্মা অর্জন করো। এ পথে তোমার এমন এক শায়খে ত্বরিকত প্রয়োজন, যিনি হবেন ইলমে দ্বীনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন কারী। তোমাকে তিনি শিষ্টাচারিতা শিখাবেন, ইলমে দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন এবং তোমাকে দেবেন সৎ উপদেশ”। হুজুর গওছে খুলনবী (রহ.) ছিলেন উপরোক্ত বাণীর অনুরুপ গুণাবলীর অধিকারী। যাঁর অন্তরকে মহান আল্লাহ প্রিয় নবীজীর চুড়ান্ত প্রেম, মহাব্বত দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন হযরত ছিদ্দিকে আকবর (র.), হযরত ইমাম বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ বুখারী (রহ.) ও ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) র আধ্যাত্মিক সম্পদের উত্তরাধিকারী, শরিয়ত, ত্বরিকত হাকিকত ও মারেফাতের একনিষ্ঠ সাধক, এতদঅঞ্চলের সুন্নিয়তের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রিয় রাসুলের আদর্শ ও নীতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যাঁর জ্যোর্তিময় চেহারায়ে আনোয়ার দর্শন ও সুমধুর ঐশী বাণী শ্রবণে মানুষের অন্তরে হেদায়তের কাজ করত, আল্লাহর ভয় জাগ্রত হতো, রাসুলের মহাব্বত সৃষ্টি হতো।তিনি ছিলেন সমকালীন যুগের গওছুল আ‘যম । তাই তিনি গওছুল আ’যম খুলনবী নামে সমধিক পরিচিত । তাঁর উচ্চ কামালিয়তের কারণে তাঁকে শুধু মানুষ নয়, পশু, পাখি, জীব জন্তু ও অসাধারণ মান্য করতেন, ক্ষেত্র বিশেষে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতেন। তাঁর অজান্তে সংগঠিত অনেক কারামতের কারণে অনেক কঠিন হৃদয়ের মানুষ উপকৃত হয়ে অথবা ভয়ে আল্লাহ ভীতি ও নবীপ্রেমে উজ্জীবিত হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীদের হাজারো বিরোধীতার ফাঁদ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। লক্ষ কোটি অন্ধকার কলবে বেলায়তি নুরের আলো প্রজ্জলন করে দিয়েছেন। হাজারো অমুসলিমকে দ্বীন ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিয়ে মুসলমান বানিয়েছেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেক সমাজকল্যাণ ও সংস্কারমূলক কাজ করেছেন। তাঁরই একনিষ্ঠ সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে নিজের শরীরের আরামকে হারাম করে প্রকৃত নায়েবে রাসুল (দ.) হিসাবে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম দ্বীন ইসলামকে পৃথিবীর বুকে আলোকোজ্জ¦ল করার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানি¯াÍন, বার্মা/মায়ানমার, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে একাধিকবার সফর করেছেন। সেখানে অমুল্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে ত্বরিক্বতের প্রচার প্রসাারে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ শরীফ, হেফজখানা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনি শিক্ষা চর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর সফরের চুড়ান্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে অন্ধকার জগত থেকে আলোকোজ্জ্বল জগতে ফিরিয়ে আনা, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুম আহকাম মেনে দুনিয়া আখেরাতে শান্তির পথ সুগম করা। তিনি ঐসব অঞ্চল / দেশ থেকে চলে আসলেও সেসব অঞ্চলের মানুষের কল্যাণের জন্য, দ্বীন ধর্মের চর্চা তথা ত্বরিকতের চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য তাঁরই সুযোগ্য খেলাফত প্রাপ্ত খলিফাগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দেশ ও অঞ্চল ভেদে যে সমস্ত খলিফাগণকে দায়িত্ব অর্পন করেছেন তাঁদের মধ্যে বার্মায়/ মায়ানমারে- শাহসূফী মাওলানা মুখলেছুর রহমান রেংগুনী (রহ.),হযরত শাহ মাওলানা আব্দুশ শকুর রেংগুনী (রহ.), পাকিস্তানে- বিশ্বখ্যাত কলম সম্রাট হযরত শাহসূফী ছৈয়দ মাহমুদ হাসান রজভী (রহ.) ও হযরত শাহসূফী মাওলানা নাঈমুদ্দীন (রহ.) ভারতে- হযরত শাহসূফী মাওলানা আলিমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.), সেরহিন্দে মাওলানা হযরত শাহসূফী মকবুল আহমদ (রহ.),চট্টগ্রামে- খলিফায়ে আ’যম হযরত শাহসূফী কাযী ছৈয়দ মুহাম্মদ ইসলাম চাটগামী (রহ.), খুলনায়- তারঁই সুযোগ্য সাহেবজাদাত্রয় হযরত শাহসূফী মাওলানা আব্দুর রহিম খুলনবী (রহ.), মাওলানা হযরত শাহসূফী মুহাম্মদ মাসুম খুলনবী (রহ.), মাওলানা হযরত শাহসূফী মুহাম্মদ সাদেক খুলনবী (রহ.), এবং তাঁরই প্রিয় দৌহিত্র খুলনা দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন মাওলানা হযরত শাহসূফী খাজা শফিক আহমদ খুলনবী (ম.জি.আ.) ও চট্টগ্রামে ধর্মপুর দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন গওছে জ’মা হযরত শাহসূফী মাওলানা কাযী সৈয়দ মুহাম্মদ আব্দুশ শকুর রায়হান আজিজী নক্শবন্দী (ম.জি.আ.) ও আওলাদে গওছুল আ‘যম চাটগামী হযরত শাহ মাওলানা তাহসিন আহমদ নক্শবন্দী (ম.জি.আ.)কে রাসুলে পাকের ইশারায় খেলাফতের মহান নিয়ামত দান করা হয়। এসব মহামান্য খলিফা ও খাস মুরিদগণ সময় ও কালের পরিক্রমায় যথাযথভাবে হযরত গওছুল আ’ যম খুলনবী (রহ.) এর পক্ষে রাসুলে পাকের পবিত্র (আমানত) ত্বরিকাকে দুনিয়ার বুকে দায়েম এবং কায়েম রাখার জন্য জীবনের সর্বস্ব ত্যাগের চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করত: ইসলামের প্রচার -প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন এবং বর্তমানেও করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরই সাধারণ মুরিদানেরা ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দ্বীন, ধর্ম, ঈমান ও ইসলামের জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে খেদমতের আন্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। হুজুর গওছে খুলনবী (রহ.) ছিলেন আজন্ম আওলিয়া, পুত: পবিত্র ও কারামতের মুর্ত প্রতীক। কিন্তু তিনি বলতেন এগুলো মহাতœা আউলিয়ায়ে কেরামের মাপকাঠি নয়। বরহক এ ক্ষেত্রে সুন্নাতে রাসুলের পরিপূর্ণ অনুসরণ ও নবী প্রেমই বুজুর্গীর একমাত্র চাবিকাঠি। রাসুল প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে আল্লাহর বান্দাদের মুর্দা ক্বলবকে জিন্দা করাই উচ্চ কামালিয়তের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর শান ও মান বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁরই একজন মহান আশেক আওলাদে রাসুল (দঃ), ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা গাজী শেরে বাংলা আজিজুল হক আলকাদেরী (রহ.) তাঁর জগত বিখ্যাত “দিওয়ানে আজিজ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন, “মৌলানার জন্য লক্ষ লক্ষ ধন্যবাদ। যাঁর নাম হল আব্দুল আজিজ খুলনবী। যিনি নির্ভেজাল ও স¦চ্ছতার মালিক। যিনি কাশ্ফ ও কারামতের অধিকারী, এবং যুগের হেদায়তকারী পীরে কামেল। তাঁর লক্ষ লক্ষ মুরিদান বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে। তিনি হলেন ওলামাদের ইমাম এবং ত্বরিকতের পথে ছালেকীন অনুসরণীয়। যাঁর কামালিয়াত লেখা বর্ণনার উর্ধ্বে। আর তাঁর কবর মোবারকে খোদার করুণা রহমতের বাতাস সর্বদা প্রবাহিত হচ্ছে।” তিনি “আহলে ছফা নির্ভেজাল ও স্বচ্ছতার মালিক” এ বাক্যটি দিয়ে ঈমাম শেরে বাংলা (রহ) বুঝাতে চেয়েছেন অনেক মশায়েখে কেরাম আছেন- যাঁদের বেলায়ত থাকলে ত্বরিক্বতের স্বচ্ছতা নেই, আর ত্বরিক্বত থাকলে ইলমে বেলায়ত নেই, কোন মশায়েখ আমলে ভরপুর থাকলেও রূহানী শক্তি শূণ্য বললেও চলে। কিন্তু হযরত খুলনবী (রহ.) এত বেশি প্রিয় নবীর সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন যে, কোন ক্ষেত্রে তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ঘাটতি ছিলনা। বিশ্বখ্যাত কলম স¤্রাট হযরত শাহ মওলানা সৈয়দ মাহমুদ হাসান রজভী (রহ.) বলেন, ’সৃষ্টির সেরা নবীর অবিকল প্রতিনিধি হলেন হযরত গওছুল আ’যম খুলনবী (রহ.)’। হুজুর গওছে খুলনবী (রহ.) শুধু সালেক ছিলেন না, সালেকীনদের দিশারী ও ছিলেন। তাঁর বেলায়তের পরিপূর্ণতার কথা বর্ণনা করে শেষ করার মত নয়। যাঁর নূরানী বেলায়তী চেহারা মুবারকের ঝালক দেখে খ্যাতনামা পীর পর্যন্ত দরবেশী জীবন পরিহার করে তাঁরই কদমে শিষ্যত্বের মস্তক অবনত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মুরিদানদের ব্যাপারে (জালালিয়াত অবস্থায়) ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন,” আমার কোন মুরিদ মুসিবতে পড়বে না, যেহেতু আমি তাদের মুর্শিদ। আমার কোন ভক্ত মুরিদান জাহান্নামে যাবে না, কারণ আমার সুনজর তাদের উপর রয়েছে”। সুতরাং, তিনি এমন এক উচ্চ মকামের অলি ছিলেন, যাঁর নাম ভক্তরা ক্ষেত্র বিশেষে ইসমে আযম হিসাবে ব্যবহার করে অনেক ফযিলত লাভ করেছেন এবং বর্তমানেও লাভ করছেন। যাঁর মাযার শরীফ যেয়ারতকারীদের কলবেও খোদায়ী শক্তির সঞ্চার হয়, যেয়ারতকারীরা ও খোদার দয়া ও করুণা প্রাপ্ত হয়। তাঁর নামের উসিলা দিয়ে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়, বিপদগ্রস্থের বিপদ দূর হয়, রোগাক্রান্তদের রোগ মুক্ত হয়, এলমহীনের অন্তরে এলমের খজিনা পয়দা হয়, অভাবীর অভাব দূর হয়। সর্বোপরি মুর্দা কলব জিন্দা হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের রেজামন্দি হাছিল হয়। এই মহান ইমামুল আউলিয়া জীবনের সবটুকু মুহূর্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য কুরবানী করে ১৯৫৬ সালের ১০ আশ্বিন মোতাবেক ১২ই রবিউল আউয়াল সকাল দশটায় কোটি কোটি ভক্ত আশেকানদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ গওছিয়তের চন্দ্র, বেলায়তের সূর্য, রহমতে ইলাহীর সাগরে অস্ত গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! তাঁর মাযার শরীফ বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার গুনাকরকাটি থানায় মহান শান-শওকতের সাথে অবস্থিত। যা আল্লাহ, রাসূল ও অলী-প্রেমিকদের মনোবাসনা পূরণের শ্রেষ্ঠতম ঠিকানা। পরিশেষে বলব, হুজুর গওছে খুলনবী (রহ.), ও তাঁর যোগ্য খলীফাগণ পাক-ভারত উপমহাদেশের ইসলামের প্রচার প্রসারে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। উল্লেখ্য যে, তাঁরই সুযোগ্য খলিফা ও একনিষ্ঠ মুরিদগণ এমন কিছু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে গেছেন/করছেন যা দ্বীন, মিল্লত ও মুসলিম জাতির জন্য কালের পরিক্রমায় নিশানে কিস্তিয়ে নুহ (আঃ) এ পরিণত হয়েছে। যা কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না । । হযরত খুলনবী (রহ.) ও তাঁর প্রধান খলিফা, পীরে ত্বরিক্বত, মুরশিদে কামিল ও মোকাম্মিল, হাদিয়ে দ্বীন ও মিল্লত, সূফীয়ে জমান, ফানা ফিশ-শায়খ, ফানা ফির-রাসূল, ফানা ফিল্লাহ, আওলাদে রাসূল সৈয়েদুনা মুরশেদুনা হযরত শাহ সূফী মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ ইসলাম চাটগামী নক্শবন্দী (রহ.) এর নূরাণী পদচারণায় বিশেষ করে- বৃহত্তর চট্টগ্রাম সহ রামু-কক্সবাজারে যেখানে বিজাতীয় সম্প্রদায়ের আদি বসবাস এবং বাতেল মতবাদের প্রচারে প্রকৃত দ্বীনের আলো থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত ছিল, সেখানেই বাতেল ও দুশমনে রসুলের ভয়ানক অঞ্চল সুন্নিয়তের প্রচারণায় মুখরিত হল। এতদঅঞ্চলের সৌভাগ্যবান আল্লাহর বান্দারা পেলেন অনাবিল শান্তির ঠিকানা ধর্মপুর দরবার শরীফ। যেখান থেকে আল্লাহর নবীর নুরের প্রজ্জ্বলিত শিখার প্রভাবে বাতেল ফিরকার কাদায় মিশ্রিত সাদা-মাটা মানুষগুলো আলোকিত হয়ে দরবারে রেসালতের ফুলের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আল্লাহর রসূল (স.) পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হন। বিজাতীয় (মগ-চাকমারা) সম্প্রদায় ইসলামের সুশীতল ছায়ায় স্থান পেল। ধর্মপুর দরবার শরীফ গাউছে খুলনার বেলায়তের ফুলের বাগান, দরবারে রেসালতের ঝরণা ধারা, নবীপ্রেমের স্থায়ী মরকয, ত্বরিকত-চর্চার আদর্শ ঠিকানা, অন্ধকার ক্বলবকে আলোকিত করার পবিত্র স্থান পরিণত করেন। এ দরবারের মহান শায়খ হযরত চাটগামী (রহ.) অনুপম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাঁরই জীবনাদর্শ রসূলে পাক সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও নীতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তিনি জযবাত ও জালালিয়াতমুক্ত ছিলেন। রুবুবিয়াত ও রহমানিয়াতের রঙে তাঁর কার্যাদি সম্পূর্ণরূপে রঞ্জিত ছিল। তাঁর চাল-চলন, কপোপকথন, আচার-ব্যবহার, ব্যক্তিজীবন, ধর্মীয় জীবন এবং সামাজিক জীবনাচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শফিউল মুজনিবীন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের প্রতিফলন ছিল পরিপূর্ণরূপে। তিনি অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি একজন পরিপূর্ণ আলেম ছিলেন। তিনি কোরআন, হাদীস, ফেকাহ, উছুলে-ফেকাহ, মানতেক, বালাগত, আকাঈদ, তাসাউফ ও দর্শন শাস্ত্রের উপর জ্ঞান-গভীর জ্ঞান রাখতেন। একজন স্বনামধণ্য ওয়ায়েজীন ছিলেন। তাঁর ওয়াজের প্রতিটি কথা, বক্তৃতা মুরিদানদের তীব্রভাবে নাড়া দিত, আন্দোলিত করত নবীপ্রেমে। হক্কানী পীর-মাশায়েখদের প্রতি তাঁর পূর্ণমাত্রায় ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল। শরীয়তের আলেমদের যথাযোগ্য সম্মান করতেন। সর্বোপরি মুরিদানদের নবীপ্রেমে উজ্জীবিত করে একজন পূর্ণমাত্রায় নামাজি ও হালাল রুজি-রোজগার করার তাগিদ দিতেন এবং বে-নামাজি ও পরের হক ধ্বংসকারীদের হুশিয়ার করে দিতেন এবং তিনি বায়াত করানোর সময় তাঁর বেলায়তের অমীয় বাণী [‘পাপ থেকে বাঁচ, পাক-নাপাক, হারাম-হালাল পরহেজ কর, শরীয়তের হুকুম আহকাম মান, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করত: আল্লাহর স্মরণ কর, নবীর উপর বেশি বেশি দরূদ পড়] দুনিয়ার মানুষের জন্য সহজে আল্লাহ-প্রাপ্তির একটি শ্রেষ্ঠতম মডেল। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন তিনি প্রিয় রাসূলের একজন প্রকৃত আশেক, খজিনা-ই-এশকে রাসূল (দঃ)। ইসলামী শরীয়তের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে ত্বরিকত, হাকিকত ও মারেফাতের কাজ করতেন।তিনি বলতেন- অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন মহাত্মা আউলিয়ায়ে কেরামের মাপকাঠি নয়। এ ক্ষেত্রে সুন্নাতে রাসুলের পরিপূর্ণ অনুসরণ ও নবীপ্রেমই বুজুর্গীর প্রকৃত চাবিকাঠি। হযরত চাটগামী (রাহ.) এর পবিত্র জিন্দেগীর প্রতিটি মুহুর্তে সুন্নাতে রাসূলের বাস্তব প্রতিফলন হতো। প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে হুজুর কেবলার মোবারক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বড় কারামত।তাঁর মাজারে পাক ধর্মপুর দরবার শরীফে অবস্থিত। হযরত চাটগামী (রহ.) দুনিয়া থেকে পর্দা করলেও তিনি আমাদেরকে অভিভাবকবিহীন রেখে যাননি বরং আমাদের জন্য রেখে যান আল্লাহ-প্রদত্ত অপরিসীম নেয়ামত, রসূলে পাকের দয়া, গাউছে খুলনার খলিফা, দুনিয়া-আখেরাতের অভিভাবক, তাঁরই সুযোগ্য জৈষ্ঠ্য শাহজাদা গওছে খুলনার ¯েœহের বাদশাহ, বেলায়তের শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র, পীরে ত্বরিকত, হাদিয়ে দ্বীন ও মিল্লাত রায়হানুদ্দুনিয়া, ফখরে আহলে সুন্নাত, জামেই কামালাত, নায়েবে লিসানে দাউদ (আঃ), সৈয়্যদুনা, মুর্শিদুনা, শাহ সূফী মাওলানা সৈয়দ কাযী মুহাম্মদ আবদুশ শকুর নকশবন্দী (ম. জি. আ.)- কে। বর্তমান হুজুর কেবলা (ম. জি. আ.) মূলতঃ নুরুন আলা নূর। অর্থাৎ তিনি গওছুল আযম হযরত শাহ মাওলানা আবদুল আজিজ খুলনবী (রহ.), পিতা- হযরত চাটগামী (রহ.) এবং গওছে জ’মান শাহসূফী মুহাম্মদ মাসুম খলনবী (রহ.)- এর কাছ থেকে খেলাফত লাভে ধন্য হন। হযরত শাহ মুহাম্মদ মাসুম খুলনবী (রহ.) শুধু তাঁকে খেলাফত দিয়ে ধণ্য করেননি,বরং তাঁকে নিজের হাতে মনের মত করে গড়ে তুলেছেন অবিকল হুজুর গওছে খুলনার সুযোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে। এতে প্রমাণিত হয় “বৃক্ষ তোমার নাম কী ? ফলে পরিচয়”। তাই বর্তমান এই কঠিন জামানায় তাঁর এই মর্তবা ! তিনি বর্তমান জমানার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সকল হক ত্বরিকতের পীর মশায়েখ ও আলেমকুল শিরোমনি। তাঁর শান, মান আমার মত নাপাক জবানে বর্ণনা অসম্ভব। তিনি তাঁরই প্রাণপ্রিয় মুর্শিদগণের ফয়েজাবে প্রকৃত আওলাদে রসূল ও নায়েবে রাসূল(দ.) হিসাবে নিজের আরামকে হারাম করে ওয়াজ নছিহত ও বিভিন্ন সংস্কার মূলক কর্ম কান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সুন্নিয়তের প্রচার ও প্রসারে ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। প্রচার বিমুখ এই মহান আধ্যাত্মিক সাধকের ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন অঞ্চলে মাদরাসা, মসজিদ, হেফজখানা, এতিমখানা ও খানকাহ শরীফ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীন, মিল্লাত মজহাব তথা ত্বরিকতের প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে খেদমতের আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন। দ্বীন ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও পথ নির্দেশনার মাধ্যমে পথ ভ্রষ্ট আল্লাহর বান্দা-বান্দিদের হেদায়তের পথ সুগম করছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমান হুজুর মোবারকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, পীর ভাই বোনদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন দরবারে একটি যুগোপযোগী ও অত্যাধুনিক সুন্নিয়া মাদরাসা, হেফজখানা, এতিমখানা, অত্যাধুনিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও তাসাউফ ভিত্তিক এ দরবারের একমাত্র মুখপাত্র মাসিক “আর রায়হান” (যা অতি অল্প সময়ে পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন), ত্বরিকত ভিত্তিক অরাজনেতিক সংগঠন আন্জুমানে নক্শবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র ও ঐতিহাসিক পবিত্র জশনে জুলূছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)র প্রর্বতন সহ দরবারের পরবর্তী খলিফা আমাদের জন্য অভিভাবক হিসাবে তাঁরই সুযোগ্য মেজ শাহজাদা, পীর ভাই-বোনদের হৃদয়ের স্পন্দন, হযরত শাহ মাওলানা তাহসীন আহমদ নকশবন্দী (ম.জি.আ.)- কে খেলাফত দান করে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। প্রতি বৎসর ১৩ ই নভেম্বর, ২৯ শে কার্তিক, চট্টগ্রামস্থ সাতকানিয়া ধর্মপুর দরবার শরীফে অতীব পবিত্র ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও শরিয়ত সম্মত ভাবে আল্লাহর মহান অলি হযরত গওছুল আ‘যম খুলনবী (রহ.) এর বার্ষিক ওরছ ও হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ ইসলাম চাটগামী (রহ.) এর বার্ষিক ফাতেহা শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ লক্ষ নবী, অলি প্রেমিকদের পদচারনায় মুখরিত হয় ধর্মপুর দরবার শরীফ। উক্ত মাহফিল পবিত্র খতমে কোরআন, খতমে খাজেগান, কোরআন সুন্নাহর আলোকে জগৎ বিখ্যাত আলেমদের রুহানি বয়ান, জিকির, মিলাদ কিয়াম, ও দোয়া মুনাজাতের পর সুশৃংখলভাবে তবারুক বিতরনের মাধ্যমে বর্তমান হুজুর মুবারকের সুদৃঢ় তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জ্বত যেন আমাদের এই মহান মুর্শিদে পাকের হায়াত বাড়িয়ে দেন এবং হযরাতে মশায়েখে কেরামগণের রূহানী ফয়ুজাত দান করে আমাদের ধন্য করুন। আমীন।
লেখক : চিকিৎসক, কলেজ শিক্ষক, সংগঠক ও প্রাবন্ধিক।