ভারতে যখন প্রায় তিন মাস ধরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছে, তার মধ্যেই রাজধানী দিল্লির একটা অংশে এ সপ্তাহের গোড়া থেকে শুরু হয়েছিল সহিংসতা । সেটাই অতি দ্রুত পরিণত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় – যাতে নিহতের সংখ্যা এর মধ্যে ৪০ ছাড়িয়ে গেছে।
প্রশ্ন উঠছে, এই দাঙ্গা কী শুধুই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আন্দোলনের পক্ষের আর বিপক্ষের সংঘর্ষ? না কি, অনেকে যেটাকে বলছেন মুসলমানদের চিহ্নিত করে নিধন করার পরিকল্পনা – সেরকম কিছু?
তা ছাড়া, এই দাঙ্গা কি নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বৃহত্তর বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ঘোরাবার প্রচেষ্টা ছিল? না কি হিন্দুত্ববাদী এবং তার বিরোধীদের মধ্যে ভাবধারার সংঘাত?
এই প্রশ্নগুলোই ঘুরছে অনেকের মাথায়।
কিন্তু দিল্লির এই দাঙ্গা কি হঠাৎ করেই শুরু হলো? না কি অনেকদিন থেকেই তৈরি হচ্ছিল এর পটভূমি?
‘রাষ্ট্রের মদতে একটা পোগ্রোম’
নাগরিকত্ব আইনের পক্ষ-বিপক্ষের মানুষরা বলছেন, মাঝ ডিসেম্বরে যেদিন থেকে শাহীনবাগে মূলত নারীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন, আর তারপরে যখন সেই প্রতিবাদের আদলেই কলকাতার পার্ক সার্কাস বা দেশের নানা জায়গায় শুরু হয় লাগাতার ধর্না – তখন থেকেই শুরু এই দাঙ্গার পটভূমি তৈরির।
লেখক দেবদান চৌধুরী বলছিলেন, “এটা সংঘর্ষও না, দাঙ্গাও না। দিল্লিতে যা হয়েছে, তার সঠিক শব্দটা হল রাষ্ট্রের মদতে একটা পোগ্রোম অর্থাৎ সংঘবদ্ধ নির্যাতন, হত্যা, লুন্ঠন।”
“পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে মুসলমান নিধন চলেছে ওখানে। কোনও ভাবেই যেন আরেকটা শাহীনবাগ যাতে না তৈরি হতে পারে।”
“শাহীনবাগ সারা দেশের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এভাবেও যে প্রতিবাদ জানানো যায়, সেটাই দেখিয়েছে শাহীনবাগ। গোটা দেশকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই ওরা ভয় পাচ্ছে শাহীনবাগকে, কারণ এতগুলো কন্ঠ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে,” – বলছিলেন কলকাতার বাসিন্দা সোহিনী গুপ্ত।
নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী প্রতিবাদকে অবশ্য মুসলমানদের প্রতিবাদ হিসাবেই দেখাতে চেষ্টা করছে বিজেপি। দলের এক কর্মী সুমন দাসের কথায় উঠে এল সেই প্রসঙ্গ।
“সি এ এ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনটা কারা করছে? যাদের রুজি রোজগার, অস্তিত্বের সঙ্কট, তারাই আছে এতে। এরা কেউ ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে তো ভারতে আসে নি – অনুপ্রবেশকারী এরা।”
“তাই যদি এদের চিহ্নিত করে আলাদা করা হয়, তাহলে এদের রুজি রোজগারে টান পড়বে। সেই আশঙ্কা থেকেই এরা আন্দোলনে নেমেছে” – বলছিলেন মি. দাস।
দিল্লির শাহীনবাগ হোক বা কলকাতার পার্ক সার্কাস অথবা উত্তরপ্রদেশ সহ ভারতের অন্যান্য যেসব শহরে মাঝ-ডিসেম্বর থেকে ধর্ণা চলছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে – আর কোনও প্রতিবাদ মঞ্চ থেকে অশান্তি ছড়ানো হয়েছে – সেরকম খবরও পাওয়া যায় নি বিশেষ।
তাহলে কেন দিল্লির জাফরাবাদের রাস্তায় যখন নারীরা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে নামলেন গত রবিবার, তখন থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলো?
কেনই বা তা পরের দিনই পরিণত হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়?
শাহীনবাগ কি একটা কারণ ছিল?
তাই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি শাহীনবাগ বা শাহীনবাগের আদলে আর যেসব প্রতিবাদ-ধর্ণা মঞ্চ গড়ে উঠেছে, সেগুলোকে বাধা দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য?
এক বিজেপি কর্মী শান্তনু বেরা শাহীনবাগের প্রসঙ্গে বলছিলেন, “আমরা দিনের শেষে বাড়ি গিয়ে যখন খবর দেখি – একটাই এজেন্ডা — শাহীনবাগ, শাহীনবাগ, শাহীনবাগ। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েই সেটা ফেটে বেরিয়েছে।”
“শাহীনবাগ হতে হতেই দিল্লির ভোট হয়েছে – তার সুফল পেয়েছে দিল্লিতে যারা সরকার গড়েছে। এখন এরা ভেবে নিয়েছে সরকার যখন আগেও আমাদের সাপোর্ট করেছে, পরেও করবে। তারা যখন আপার হ্যান্ড পেয়েছে, তারা আরও অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে।”
দিল্লির সদ্যসমাপ্ত বিধানসভার যে প্রসঙ্গ আনলেন মি. বেরা। সে সময়েই অভিযোগ উঠেছিল যে বিজেপির শীর্ষ নেতারা নির্বাচনী প্রচারে বারে বারেই টার্গেট করছেন শাহীনবাগ আর নাগরিকত্ব বিল বিরোধী আন্দোলনকে।
এ নিয়ে অভিযোগও জমা পড়ে নির্বাচন কমিশনে।
দিল্লির নির্বাচন থেকেই উস্কানির শুরু
কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, শাহীনবাগের মতো যেসব জায়গায় নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন চলছে সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার উস্কানি দেওয়া হয়েছিল ওই নির্বাচনের সময় থেকেই।
“উস্কানিটা শুরু হয়েছিল সেই দিল্লির নির্বাচনের সময় থেকেই। বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা কেউ বলেছেন, দেশ কি গাদ্দারোঁকো গোলি মারো, কেউ বলেছেন – এত জোরে ভোটযন্ত্রে বিজেপিকে ভোট দিন, যাতে শাহীনবাগে কারেন্ট লাগে। এটাকে যদি ভোটজয়ের কৌশল বলা হয়, তাহলে বলব খুবই খারাপ কৌশল ছিল এটা।”
“আর নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও জমা পড়েছিল ওইসব মন্তব্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই দুর্বল,” বলছিলেন মি. মৈত্র।
পার্ক সার্কাসে শুধু নয়, দিল্লির দাঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভ কলকাতার নানা জায়গায় হচ্ছে কদিন ধরে। নানা অরাজনৈতিক সংগঠনের লোকেরা বা বামপন্থীরা যোগ দিচ্ছেন সেই সব বিক্ষোভে-মিছিলে।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমেও চর্চা চলছে দিল্লি দাঙ্গার কারণ, উৎপত্তি, নিয়ে – বীভৎসতা নিয়ে।
দাঙ্গাবিরোধী এরকমই একটা সভায় কথা হচ্ছিল রাফয় সিদ্দিকির সঙ্গে।
তিনি বলছিলেন, “প্রায় তিনমাস ধরে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কোথাও তো শান্তি বিঘ্নিত হয় নি। তাহলে এখন কেন হলো? দিল্লিতে যা হলো, তা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে ওরা শান্তি চায় না, দাঙ্গা চায়।”
“বেছে বেছে ঘর, দোকান, মসজিদ, মাজার লক্ষ্য করে আক্রমণ হয়েছে। এরা চেয়েছে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধুক” – বলছিলেন মি. সিদ্দিকি।
পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন
যে দ্রুততার সঙ্গে দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দাঙ্গা ছড়িয়েছে, আর তার যা সব ভিডিও এবং প্রতিবেদন সামাজিক ও গণমাধ্যমগুলিতে দেখা গেছে, তাতে প্রথমদিকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এই প্রশ্ন তুলেছে দিল্লি হাইকোর্টও, যদিও সেই বিচারপতিকে একদিনের মধ্যেই বদলি করে দেয়া হয়।
দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক নন্দিতা রায়ও উত্তরপূর্ব দিল্লির এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার জন্য প্রশাসন এবং পুলিশকেই দায়ী করছিলেন।
ঘটনাচক্রে দিল্লির পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন – যে দপ্তরের মন্ত্রী অমিত শাহ।
নন্দিতা রায়ের কথায়, “আমি তো বলব এটা পুরোপুরি প্রশাসনিক ব্যর্থতা। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর নিয়ে এতটাই ব্যতিব্যস্ত ছিল, যে উত্তেজনা যখন শুরু হল, তখন কোনও ব্যবস্থাই নেয় নি। গোয়েন্দারা কী করছিলেন? তাদের কাছে তো খবর থাকার কথা ছিল যে কারা কোথায় ধর্ণা আন্দোলনের বসতে চলেছেন।”
“এই যে লাফিয়ে লাফিয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বহু মানুষ আহত, এর দায় তো পুলিশ প্রশাসনেরই” – বলেন তিনি।
গুজরাটের দাঙ্গার সাথে মিল?
পুলিশ প্রশাসনের প্রথমেই দাঙ্গা থামাতে উদ্যোগ না নেওয়া এর আগেও একবার চোখে পড়েছে মানুষের — সালটা ছিল ২০০২, স্থান গুজরাত – তখন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
“ওই সেনা অফিসার লিখেছিলেন যে আহমেদাবাদে তিনি বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। রাজ্য সরকারের কথা ছিল তাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার। সেই গাড়ির অপেক্ষা করতে করতেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।”
“শেষমেশ তিনি গভীর রাতে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাতও করেছিলেন। এ সবই তার লেখা বইটিতে আছে। বইটিতে যে অসত্য লেখা হয়েছে, তা বলা যাবে না, কারণ বইটি বিক্রি হয়, নিষিদ্ধ করা তো হয় নি,” বলছিলেন শুভাশিস মৈত্র।
২০০২-এর গুজরাত আর ২০২০-র দিল্লি — দুই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মিল পাচ্ছে অনেক সংবাদ মাধ্যমও। সেইরকম শিরোনামও করা হচ্ছে অনেক পত্রিকায়।
তবে দিল্লির দাঙ্গায় বহু প্রাণহানি এবং সম্পত্তিহানি হওয়া সত্ত্বেও এর একটা ইতিবাচক দিক দেখছেন রাজনৈতিক ভাষ্যকার দেবাশিস ভট্টাচার্য।
প্রতিবাদ কি আরো বাড়বে?
তিনি বলছিলেন, “শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপরে হামলা প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেবে, প্রতিবাদের স্থান আরও বেড়ে যাবে বলেই আমার ধারণা।”
দিল্লির উত্তরপূর্বে যখন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে দাঙ্গার বীভৎসতার ছবি আর প্রতিবেদন, তার মধ্যেই চর্চা হচ্ছে দাঙ্গার ক্ষত কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে, তা নিয়েও।
কেউ একদিকে মনে করছেন, এর ফলে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ আরও ছড়িয়ে পড়বে।
উল্টোদিকে নিহতদের মধ্যে কতজন কোন ধর্মের – সেই খোঁজেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন কেউ কেউ।
তা থেকেই অনেকের আশঙ্কা, কে হিন্দু, কে মুসলমান বা কে জাতীয়তাবাদী আর কে দেশবিরোধী – এই বিতর্ক বোধহয় এখনই থামবে না। উল্টো আরও বাড়তেই থাকবে।
সূত্র: বিবিসি