কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। সোমবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যা ৬ টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এন্ড্রু কিশোরের সতীর্থ শফিকুর আলম বাবু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দেশ বরেণ্য এই শিল্পী দীর্ঘদিন ধরেই ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা দুজনই অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা করছেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু এবং ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক দেশে ফেরার জন্য রওনা দিয়েছেন বলে জানান শফিকুর ইসলাম বাবু।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন দেশ বরেণ্য এই শিল্পী। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার ৯ মাস পর গত ১১ জুন রাতে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন তিনি।
সোমবার সন্ধ্যায় তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতির কথা জানিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল।
এমন অবস্থায় বেঁচে ওঠার আশা করতে পারছেন না জানিয়ে এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না’।
লিপিকা লিখেছেন, ‘ক্যানসারের শেষ ধাপে খুব যন্ত্রণাদায়ক। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার মনে হল, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত শ্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
তিনি লিখেছেন, ‘এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকব, মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন আর এন্ড্রু কিশোরের এর প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’
শিল্পী এ্যান্ড্রূ কিশোরের জন্ম ৪ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
এন্ড্রু কিশোর ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ১৫ হাজার গান গাওয়া শিল্পী।
এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’, ২. ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ৩. ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ৪. ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ৫. ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ৬. ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ৭. ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ৮. ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ৯. ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ১০. ‘পড়ে না চোখের পলক’, ১১. ‘পদ্মপাতার পানি’, ১২. ‘ওগো বিদেশিনী’, ১৩. ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ১৪. ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’, ১৫: ‘আর কোনদিন তোমায় আমি প্রিয় নামে ডাকবো না’ সহ আরো অনেক গান:
তিনি মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার। এছাড়াও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সাল ও নির্বাচিত গান:
১৯৮২: বড় ভাল লোক ছিল
১৯৮৭: সারেন্ডার
১৯৮৯: ক্ষতিপূরণ
১৯৯১: পদ্মা মেঘনা যমুনা
১৯৯৬: কবুল
২০০০: আজ গায়ে হলুদ
২০০৭: সাজঘর বিজয়ী
২০০৮: কি যাদু করিলা
সিনেমার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার পান তিনি।
বাচসাস পুরস্কারের সাল ও নির্বাচন গান:
১৯৮৭: স্বামী স্ত্রী
২০০১: প্রেমের তাজমহল
২০০৮: মনে প্রাণে আছ তুমি
২০১০: গোলাপী এখন বিলাতে
এছাড়াও ১৯৯৮ সালে পদ্ম পাতার পানি’ গানটির জন্য মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পান তিনি।