আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন: ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সাথী (হযরত মুহাম্মাদ দ.) পথভ্রষ্ট হননি ও বিপথগামীও হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। তাঁকে শিখিয়েছেন শক্তিধর ফেরেশতা (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হলো। তখন সে ঊর্ধ্বদিগন্তে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। তখন তিনি (আল্লাহ) ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। তাঁর (রাসূল দ.) অন্তর মিথ্যা বলেনি যা দেখেছে। তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে, যা তিনি দেখেছেন। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা দ্বারা ঢাকার কথা; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ’-(সুরা নাজম:১-১৮)।
মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন, সিড়িঁ, আরোহন এবং এর বহুবচন ‘মা’আরিজ’। পরিভাষায় মিরাজ হলো, নুরে মুজাস্সাম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতবা (দ.) কর্তৃক স্বশরীরে, স্বজ্ঞানে, জাগ্রত অবস্থায় হযরত জিবরাইল (আ.) এর সঙ্গে বিশেষ বাহন ‘বোরাক’ এর মাধ্যমে মসজিদুল হারাম থেকে জেরুযালেমে বাইতুল মাকদিস (মসজিদুল আকসা) হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী ‘রফরফ’ বাহনে আরশে আযিম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও আম্বিয়ায়ে কেরামগণের সাথে সাক্ষাৎ ও জামাতে নামায আদায়, বায়তুল মামুর-জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে প্রশান্ত হৃদয়ে দুনিয়ার জমিনে ফিরে আসা। আর মসজিদুল হারাম থেকে জেরুযালেমে বাইতুল মাকদিস (মসজিদুল আকসা) পর্যন্ত ভ্রমনকে ‘ইসরা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। অর্থাৎ মিরাজের একটা অংশ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। হিযরতের ১৬, ১৭, বা ১৮ মাস পূর্বে, ১৭ রবিউল আউয়াল, ১৭ রমযান বা ২৭ রজব (এই মতটি সকলের নিকট গৃহীত) রাতেই লাইলাতুল মিরাজ সংঘটিত হয়।
পবিত্র মিরাজ রজনীতে আল্লাহর হাবীব (দ.) মহান আল্লাহ হতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাঈল (পবিত্র কুরআনের ১৭ নং সুরা) উপহার লাভ করেন। এই সুরায় মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য কিছু নীতিমালা প্রদান করেছেন। সেগুলো হলো- ১. যে ভাল কাজ করবে, সে নিজেরই ভাল করবে। আর যে মন্দ করলে নিজেরই মন্দ করবে। (১৭:৭); ২. আল কুরআন সবচেয়ে সঠিক ও ন্যায় পথ প্রদর্শনকারী। (১৭:৯); ৩. প্রত্যেক ব্যক্তির কৃতকর্মের আমলনামা তাঁর গলায় বাঁধা রয়েছে। (১৭:১৩), ৪. কেউ কারো পাপের বোঝা বইবে না। (১৭:১৫), ৫. যার লক্ষ্য দুনিয়া প্রাপ্তি, আল্লাহ তাকে এখানেই তা দিয়ে দেন। তার পরকালের প্রাপ্তি জাহান্নাম। (১৭:১৮), ৬. যে মুমিনের লক্ষ্য পরকালের সাফল্য, সে অবশ্যই তা লাভ করবে। সে দুনিয়ার অংশও পাবে। (১৭:১৯,২০), ৭. আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ইলাহ মানা যাবে না এবং ইবাদত করা যাবে না। (১৭:২২,২৩), ৮. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। (১৭:২৩,২৪), ৯. নিকট স্বজনদের তাদের অধিকার দিতে হবে। (১৭:২৬), ১০. মিসকিনদের ও পথিকদের অধিকার দিতে হবে। (১৭:২৬), ১১. অপচয় কোরো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। (১৭:২৭), ১২. কৃপণতা কোরো না। (১৭:২৯), ১৩. সব খরচ করে নিঃস্ব হয়ো না। (১৭:২৯), ১৪. দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করবে না। (১৭:৩১), ১৫. ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না। (১৭:৩২), ১৬. গ্রাস করার উদ্দেশ্যে এতিমের সম্পদের কাছেও যেয়ো না। (১৭:৩৪), ১৭. প্রতিশ্রæতি পূর্ণ কোরো। (১৭:৩৪), ১৮. মাপে পূর্ণ দাও। (১৭:৩৫), ১৯. তার পক্ষে অবস্থান কোরো না যাতে তোমার জ্ঞান নেই। (১৭:৩৬), ২০. পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। (১৭:৩৭), ২১. উত্তম ও সুন্দর কথা বলো। (১৭:৫৩), ২২. শয়তানের অনুগামীরা জাহান্নামী। (১৭:৬৩), ২৩. মানুষের মর্যাদা রক্ষা করো। (১৭:৭০), ২৪. সালাত কায়েম কর ও কুরআন পাঠ কর। (১৭:৭৮) মানবজাতির জন্য একান্ত মান্য এসব নীতিমালা দুনিয়ার জীবনে যথাযথ ভাবে পালন করে মানুষ ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ লাভ করার সাথে সাথে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করে মহান সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই মানবকুলের লক্ষ্য ও গন্তব্য।
আল্লাহর রাসূল (দ.) এর মিরাজ আমাদের সেই লক্ষ্য ও গন্তব্যের সন্ধান দেয়। মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মানুষের সর্ম্পকের গভীরতা অনুধাবন করা যায়। মানুষ যে সৃষ্টিকর্তা মহান জাতে পাকের নৈকট্য লাভের মাধ্যমে সুফি পরিভাষায় ফানা ও বাকার স্থরে উপনিত হতে পারে, মিরাজ আমাদের তাই শিক্ষা দেয়। আল্লাহর রাসূলের (দ.) মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরে, সুরা বনি ইসরাইলে ১নং আয়াতে উল্লেখিত ‘আবদ’ শব্দে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ শুধু আত্মাকে আবদ বলে না; বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকেই আবদ বলা হয়। এটা মহানবী (দ.) এর বিশেষ মর্যাদা। আর উম্মতে মুহাম্মদী স্বশরীরে মিরাজ করতে সক্ষম না হলেও আত্মিক ভাবে সক্ষম হবে। যেমন সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে, আল্লাহর নবী (দ.) বলেছেন, ‘মুমিন যখন নামাযে দাড়ায় তখন সে আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলে’-(৪১৩)।
আল্লাহ ও তাঁর হাবীব (দ.) এর প্রেম-প্রীতি-মিলনের একান্ত তাৎপর্যমÐিত ঘটনা মিরাজের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ উম্মতের জন্য মহান আল্লাহর নৈকট্যের অভীষ্ট লক্ষ্য তথা মনযিলে মকসদে পৌঁছার এক অনন্য রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে। সে রোডম্যাপ অনুসরণ করার মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে ধন্য হওয়াই উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া আবশ্যক।
লেখক-আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল, প্রাবন্ধিক।